বাড়ি ফেরার মূল স্রোত শুরু-ঢাকার যানজট এড়াতে ট্রেন সার্ভিস by পার্থ সারথি দাস

কমলাপুর রেলস্টেশনের পাঁচ নম্বর প্লাটফর্ম। দুপুর ২টায় দাঁড়িয়ে আছে 'সিল্কসিটি'। ট্রেনটির সামনের অংশে যোগ করা হচ্ছে ইঞ্জিন। বৃষ্টি পড়ছে। ট্রেনের ভেতরটাও পরিষ্কার করছেন কর্মীরা। আর কিছু সময় পর রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যাবে এটি।


ট্রেনে মোট ১৮টি কোচ। সেগুলোয় যাত্রী আর যাত্রী। 'ক' নম্বরের কোচের বদলে ভুল করে 'ঝ' নম্বরের কোচে উঠে পড়েছেন জাকিউল ইসলাম। ভিড় ঠেলে নির্ধারিত কোচে যেতেও পারছেন না। ভিড়ে দাঁড়িয়েই ঘামতে থাকলেন তিনি। কণ্ঠে তাঁর ক্ষোভের সুর নেই। বরং বললেন, 'তিন দিন অপেক্ষা কইরা একটা টিকিট পাইছি। ট্রেইনে উঠতে পারছি, এইডাই বড় কথা।'
দুপুর আড়াইটা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) কমলাপুর ডিপো। দূর থেকেই দেখা গেল, যাত্রীরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে যাত্রী ও পরিবহনকর্মীদের কাছে জানা গেল, একটু পরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর কুমিল্লার উদ্দেশে বিআরটিসির দুটো বাস ছেড়ে যাবে। টিকিট কিনতেই এই ভিড়। এরপর বিকেল ৪টায় নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে আরো একটি বাস। এই বাসের জন্যও টিকিট কিনতে জড়ো হয়েছেন কয়েকজন। ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হলেও বিআরটিসির ঈদসেবা শুরু হয়নি। এটি শুরু হবে আজ বুধবার থেকে। কিন্তু ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে গতকাল থেকেই বিআরটিসির বাসে শুরু হয়েছে ঘরে ফেরা। নেত্রকোনার দুর্গাপুরে নিজের বাড়িতে ঈদ করতে অন্য অনেকের মতো এসেছেন মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান। জানালেন, নির্বিঘ্নে বাড়ি গিয়ে ঈদ করতেই আগেভাগে এখানে এসেছেন। টিকিট পাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।
ঈদ সামনে রেখে গতকাল মঙ্গলবার থেকে বাড়ি ফেরার মূল স্রোত শুরু হয়েছে রাজধানী থেকে। গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও বিভিন্ন কাউন্টার যাত্রীদের আনাগোনায় সরগরম হয়ে ওঠে। যানজট আর দুর্ঘটনা এড়াতে এবার পরিবার-পরিজনকে আগেভাগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন অনেকে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও স্টেশন প্রাঙ্গণে প্রচার চালাচ্ছে ব্যানার টানিয়ে। কমলাপুর রেলস্টেশনে ওই ব্যানারে লেখা রয়েছে, 'পরিবার-পরিজনকে ঈদের ভিড় হওয়ার আগেই পাঠিয়ে দিন'। ঈদে বাড়ি ফেরা সামনে রেখে গতকাল থেকে ট্রেনে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়েছে ১৪ থেকে ১৮ আগস্টের।
গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সিল্কসিটি ছাড়াও মহানগর, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, কালনী, অগ্নিবীণা, রংপুর এক্সপ্রেস, মহুয়া, উপকূল, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ বিশেষ ট্রেনে ঈদযাত্রীদের ভিড় ছিল। গতকাল সকালে রেলস্টেশনে গিয়ে ঈদযাত্রীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন যোগাযোগ ও রেলপথমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তবে রাজধানীর ভয়াবহ যানজটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনে উঠতে যাত্রীরা সতর্ক ছিলেন। তাঁরা আগেভাগেই স্টেশন প্রাঙ্গণে পৌঁছে যান। গতকাল রাজশাহীর উদ্দেশে সিল্কসিটির ছেড়ে যাওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর ২টা ৪০ মিনিট। কিন্তু দুপুর ১২টার মধ্যেই ট্রেনের অনেক যাত্রী স্টেশনে উপস্থিত হন। রাজশাহীর বারেক রহমান তিন বন্ধুকে নিয়ে নগরীর মোহাম্মদপুর থেকে রওনা দেন সকাল সাড়ে ৯টায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টায় তাঁরা যানজটে আটকে থেকে তবেই স্টেশনে পৌঁছেন। বারেক বলেন, অন্য তিন বন্ধু ও নিজে মিলে বাড়তি ৪০০ টাকায় টিকিট পেয়েছেন। রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের সংবাদ সম্মেলন করে টিকিট কালোবাজারে নেই বলে দাবি করেছেন। কিন্তু গতকাল রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী সকালে স্টেশন প্রাঙ্গণে চারটি টিকিটসহ এক কালোবাজারিকে আটক করেছে। এই কালোবাজারির নাম মো. ফিরোজ আহম্মেদ। সে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার রাজকালী গ্রামের আহম্মদ সফির ছেলে। মাওলানা ভাসানী হলের এক ছাত্রের কাছে সে চারটি টিকিট বিক্রি করতে চাইলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করেন। এ ব্যাপারে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট ইকবাল হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, এই কালোবাজারিকে কমলাপুর জিআরপি পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে।
যানজট এড়াতেও ট্রেন : রাজধানীর যানজট এড়ানোর জন্য গতকাল অসংখ্য যাত্রী ট্রেনে উত্তরাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যান। এ ধরনের একজন উত্তরাবাসী ব্যবসায়ী এনামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, "কমলাপুরে ট্রেনের 'গ' শ্রেণীর একটি টিকিট কিনেছি ছয় টাকায়। যেকোনো ট্রেনে উঠে বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে পড়ব।" দুপুর দেড়টার দিকে তিনি অপেক্ষারত মহুয়া ট্রেনে উঠে পড়েন। তিনি জানান, যানজটের কারণে সড়কপথে উত্তরায় যেতে দুই ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু ট্রেনে লাগবে সর্বোচ্চ ১৫-২০ মিনিট। এখন রাজধানীর যানজটের কারণে শুরুতেই তিন-চার ঘণ্টা বিলম্ব হচ্ছে বাস ও মিনিবাসে। বিআরটিসির ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটের সুপারভাইজার নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, মগবাজার, বনানী, কাকলী, আব্দুল্লাহপুর হয়ে গাড়ি নিয়ে বের হতে হলে কম হলেও আড়াই ঘণ্টা যানজটে থাকতে হয়।
ঈদের কেনাকাটার জন্য রাজধানীতে যাত্রী নিয়ে অতিরিক্ত যানবাহন ঢুকছে। হাতের ইশারায় এই যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ট্রাফিক পুলিশ। মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অধীন দুই হাজার ২৭৪ কিলোমিটার সড়কে ৬৫০টি ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৭০টিতে সংকেত বাতি রয়েছে। কিন্তু রাস্তায় গাড়ি রয়েছে সাত লাখের মতো। ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) আলমগীর কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনের প্রতি সচেতনতা না বাড়ালে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে না।

No comments

Powered by Blogger.