বাসের অজ্ঞান পার্টি আর রাতের ফেরি by মাজেদুল নয়ন

শাহ আলী ফেরি দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এমএম পরিবহন জুড়ে হৈ চৈ। ফেরিতে এদিক সেদিক যে লোকগুলো ঘুরছিল, বাসে এসে হতবাক। সহযাত্রী দুজন অজ্ঞান হয়ে রয়েছে।

শার্ট পড়া এক যুবকের (আনুমানিক ৩৫) সব কিছু নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। আরেকজন টি শার্ট পড়া যাত্রীর (আনুমানিক ৪০) কিছু নিতে পারেনি তবে, জ্ঞান ফিরছেনা। বাসে শুধুই অজ্ঞান পার্টি সব নিয়ে গেছে, সব নিয়ে গেছে হৈ হৈ। যাত্রীরা নিজেদের মালামালের দিকে শুধু চোখ দিয়েই আশ্বস্ত হচ্ছে না, ধরেও নিশ্চিত হচ্ছেন।
বাসের চালকের এসবে কিছুই যায় আসে না। চালাচ্ছেন নিজের মতোই। আর উৎসুক যাত্রীদের ভীড় বাড়ছিল বাসের সামনের অংশে। এদের বাড়ি কই? পানি দেও, ক্যামনে হইল? যারা করছে ওরা কই? এ জন্যেই বাসে লোকাল যাত্রী ওঠানো ঠিক না.... এ ধরনের নানা প্রশ্ন আর মন্তব্যে বাস সরগরম।

কেউ বলছে পাশের সিটে বসা লোকগুলো করেছে এ অপকর্ম, কেউ বলছে ফেরিতেই বাসে উঠেছিল অজ্ঞান পার্টি... তাৎক্ষণিক ১০ থেকে ১২ জনের তদন্ত দল কোনো কূল কিনারা করতে পারলো না।

এরই মধ্যে একজন নেতা গজিয়ে গেছেন। যে লোকটার কিছু নিতে পারেনি, তার পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে ফোন দিচ্ছেন একে ওকে। কোনো কূল কিনারা হয়নি। তবে এ দু যাত্রীর গন্তব্যস্থল নিশ্চিত হওয়া গেছে। একজন কুষ্টিয়ার, আরেকজন পাংশা।

সহকর্মী নাজমুল হাসান ছবি তুলতে গেলে, একটি গলার আওয়াজ হুমকি দিয়ে ওঠে, ‘আপনে কি লোকটার পেটে লাত্থি মারতে চান!’ পরে জানা গেল উনি বাসের হেলপার, চান না বাসের বদনাম হোক।

অসাবধানতা থেকে এ ধরনের অনাকাক্সিখত ঘটনা ঘটতে পারে, তাই হয়তো রিপোর্ট ও ছবি হলে ভাল হতো, পড়ে মানুষ সাবধান হতো, নাজমুলের এ সাংবাদিক ভাবনা আর টিকলো না। বসে পড়লেন নিজের সিটে।

বাসের সামনে থেকে ঘটনার তদন্ত করে পেছন দিকে যারা আসছিল, তাদের তথ্যে অসঙ্গতি স্পষ্ট। কেউ বলছে, টাইগার এনার্জি ড্রিংক খাইয়েছে পাশের যাত্রী, কেউ বলছে মলম দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে, আবার কেউ মুখে রুমাল দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছে বলেও জানাচ্ছেন।

তদন্তের ভার নিয়ে নিজে যখন বাসের সামনে গেলাম, ততক্ষণে মাতব্বর গোছের লোকটি মোবাইলে একজনের আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে। সেটা নিয়ে আশপাশের যাত্রীদের সংবাদ সম্মেলন করছেন তিনি।

যার কোনো খোঁজ জানা গেল না, পরামর্শ দিলাম, তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে পুলিশকে জানানোর। মাতব্বর গোছের লোকটি প্রতিবেদকের পরামর্শ শুনে বলল, ‘ভাই কথা না বইল্যা জায়গায় বসেন।’

আমাদের আশপাশের সিটগুলো থেকে তখন যাত্রীদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বের হয়ে আসছে। কারো মামা, কারো বাবা, কারো আত্মীয়ের আত্মীয় বা বন্ধুর বন্ধুর কাছ থেকে শোনা এ ধরনের অপরাধের পূর্ব কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন একজন আরেকজনকে। বেরিয়ে আসছে এ ধরনের অপরাধের অন্তরালে আর কি কি হতে পারে, অজ্ঞান পার্টির ইতিহাসসহ আরো অনেক কিছু।

এরই মধ্যে এক যাত্রী বলে ওঠেন সব দোষ বাসের কর্মচারীদের। ‘আমরাতো সব সময় ফেরি দেখি না তাই দেখতে নামি, এরাতো সারাদিনই দেখে, এদের সবার বাস থেকে নামার দরকার কি ছিল?’ কম করে হলেও আরও ১০ জন বকতে শুরু করলো চালক, হেলপার আর কন্ট্রাকটরকে।

অজ্ঞান অবস্থায় থাকা দুজন যাত্রীকে বেকুব আখ্যায়িত করে বুদ্ধিমান যাত্রীদের কয়েকজন বলেন, ‘ কেউ দিলেই কিছু খাইতে অইবো? কোই থেইক্যা আসে এসব আহম্মক’। বিপদে পড়া যাত্রীদের বোকামি নিয়ে হাসাহাসিও করছেন অনেকে।

বাসের এ গরম ঘটনায় পেছনে পড়ে যায়, শাহ আলী ফেরির ফেরিওয়ালদের গল্প। চানাচুরওয়ালা, ডিমওয়ালা, পপ কর্ণ বিক্রেতা ও চা বিক্রেতার সঙ্গে টুকটাক কথা।

এ ফেরির দোতলায় ১৪ বছর ধরে চা বিক্রি করছেন মানিকগঞ্জের বাসাদ। দু’বৌ এর ঘরে ৬ ছেলে মেয়ে।

পদ্মা সেতু হলে এ ঘাটে যানবহন চলাচল কমবে, ব্যবসা করবেন তখন? জানতে চাইলে উত্তর দেন, ‘আগে সেতু হোক পরে দেখা যাবে। অন্য ব্যাবসা করুম।’
রোববারই পদ্মা সেতুর জায়গা দখলের জন্যে মাওয়া ঘাটে বহু দোকান পাট উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।’

শিশুরা পপকর্ণ খেতে পছন্দ করলেও নিজের ছেলে মেয়েদের খাওয়াতে পারেন না পপকর্ণ বিক্রেতা রশিদ। জানালেন, ঘাট থেকে ৮ টাকা করে কিনে এনে ফেরিতে ১২ টাকা করে বিক্রি করেন। ৬ বছরের মেয়ে এবং ২ বছরের ছেলের জনক রশিদ।

পাটুয়ারি ঘাটে বাড়ি বলে অন্য চানাচুর বিক্রেতাদের চাইতে ফেরিতে প্রভাবশালী ২২ বছরের মোনায়েম। বললেন, যাগো বাড়ি ঘাটে তাগোতো ক্ষমতা বেশি থাকবোই। বছর তিন আগে বিয়ে করেছেন তিনি।

চানাচুর বিক্রি করে দৈনিক তিন থেকে চারশ টাকা আয় করলেও মোনায়েম বলেন, ‘ঘাটের টাকা ঘাটেই থাইক্যা যায়। ওই পাড়ে রাইখ্যা দেয়।’

ফেরি তখনো পাটুরিয়া ঘাটের কাছাকাছি।

No comments

Powered by Blogger.