আসন্ন খাদ্য সংকট ও আমরা by ফারহাত জাহান

লড়ছে মানুষ ক্ষুধার সঙ্গে। প্রযুক্তি ও যোগাযোগের শিখরে পেঁৗছানো আজকের বিশ্বে প্রতিদিন এক বিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। এটা বলছে বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, প্রতি আটজন মানুষের মধ্যে একজন পুষ্টিহীনতার শিকার।


এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে দরিদ্রতা দূরীকরণে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০১২ সালের খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে সামনে এনেছে 'কৃষি সমবায় : 'ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের চাবিকাঠি (ধমৎরপঁষঃঁৎব পড়ড়ঢ়বৎধঃরাবং : শবু ঃড় ভববফরহম ঃযব ড়িৎষফ)।' খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তাই কৃষি সমবায়, উদ্যোক্তা সংগঠন ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানে অধিক বিনিয়োগ ও সহায়তার কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে এখানে। কার্যত এ ঘোষণা অধিক উৎপাদন তত্ত্বকে নাকচ করেছে। আর এ কারণেই এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে_ এ কথা শোনার পর দেশ আনন্দিত হয়েছে; কিন্তু ব্যথিতও হয়েছে। তারপরই যখন লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট পত্রিকার ২০১২ সালের র‌্যাঙ্কিংয়ে খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে সবার নিচে। সে আনন্দ আরও ম্লান হয়েছে যখন বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিং হয় ১০৫টি দেশের মধ্যে ৮১তম হিসেবে। এই র‌্যাঙ্কিং করার ক্ষেত্রে গবেষক দল তিনটি বিষয় বিবেচনায় আনেন_ এক. খাবার কেনার সামর্থ্য; দুই. সহজ প্রাপ্যতা এবং তিন. খাবারের গুণগত মান। এ তিনটি কারণের মধ্যে মূলত দ্বিতীয় কারণটির অভাব বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘ খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার মতে, শুধু জুন-জুলাই এ দুই মাসে ২০১২ সালে বাংলাদেশের খাবারের দাম বেড়েছে শতকরা ৬ ভাগ এবং এ সংস্থারই 'খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা প্রতিবেদন ২০১১' অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্য মূল্যে ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মূল কারণ। আমেরিকা আর ব্রাজিলে খরা, অস্ট্রেলিয়ায় অতিবৃষ্টি আর ভারতের কোনো কোনো স্থানে খরা খাদ্য নিরাপত্তাকে বিঘি্নত করেছে, ত্বরান্বিত করেছে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি। তাই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে
আমদানিকৃত গমের দাম টনপ্রতি ৪৫ ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরকার এখন চিন্তিত। কেননা বিশ্ববাজার থেকে তাকে বর্ধিত মূল্যে কিনতে হবে তেল, চিনি ও ভোজ্যতেল। তাই কেবল বাম্পার ধান উৎপাদন করেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। কেননা খাদ্যদ্রব্যের আমদানি নির্ভরতা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, উপকরণনির্ভর কৃষির বিস্তার খাদ্য নিরাপত্তাকে বাধাগ্রস্ত করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুবিধ ঘটনাপ্রবাহ খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে জড়িত বটে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অসংখ্য বিষয় খাদ্য অনিরাপত্তাকে বাড়িয়ে তুলেছে; চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, খাদ্য সংরক্ষণাগারের অভাব, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য অপর্যাপ্ত কৃষিসেবা, কৃষির ওপর বাণিজ্যিক আগ্রাসন, স্থায়িত্বশীল কৃষিচর্চার অভাব এবং ক্রমাগত জলবায়ুর পরিবর্তন খাদ্য সংকটকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই অধিক ধান উৎপাদনের কৃত্রিম সন্তুষ্টির বলয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ অন্যান্য খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল, চিনি ও মসলার জন্য আমাদের বিশ্ববাজারের মুখাপেক্ষী হতে হয়। আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ২০০৮ সালের বিশ্ব খাদ্য মন্দার প্রভাব বাংলাদেশকে ভালোই কাবু করেছিল।
বাংলাদেশ আজও নিম্ন আয়ের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশ; শতকরা ৩৩ ভাগ লোক ক্ষুধা ও দরিদ্রতার সঙ্গে লড়ছে। জনগণের প্রধান খাদ্য হচ্ছে চাল, খাদ্যের ৬০ শতাংশই হচ্ছে ভাত। শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য তালিকায় মাছ-মাংস-ডিম-দুধ-শাকসবজির রয়েছে বিরল উপস্থিতি। অতীতে মানুষের কিছু প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎস ছিল; আশপাশের ঝোপঝাড়, বাড়ির উঠান, খাল-বিল, উন্মুক্ত জলাশয় ও জলাশয় সংলগ্ন জমি থেকে সাধারণ গ্রামীণ মানুষ মাছ ও শাক-লতা সংগ্রহ করত, বাড়ির উঠানে সবজি চাষাবাদ করত, করত হাঁস-মুরগি পালন। কিন্তু বাজারনির্ভর অর্থনীতি এসব প্রাকৃতিক উৎসকে সীমিত করেছে, একই সঙ্গে সীমিত করেছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ইতিমধ্যে বিকশিত খাদ্য নিরাপত্তার ধারণা ও বাস্তবতা হলো চাল বা ভাতকেন্দ্রিক। যা কেবলই কার্বোহাইড্রেট বা উষ্ণতার উৎস। ভিটামিন-মিনারেল-প্রোটিন ইত্যাদি মানব জীবন গঠনের অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎসগুলোর বিষয়ে আমরা বড়ই নীরব। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা কেবল ধান উৎপাদনের মাপকাঠিতে রাষ্ট্রকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘোষণা করেন। স্বভাবিকভাবেই বলা যায়, কেবল ধানে পর্যাপ্ত উৎপাদনই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়, এটি অনেকগুলো পর্যায়ের একটি ধাপমাত্র। বিশ্ব দরবারে ক্ষুধার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিহীনতা আজ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত। খাদ্য নিরাপত্তার বহুমাত্রিকতা বিবেচনা করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বিবেচনা করা জরুরি স্থানীয় জ্ঞান ও ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ব্যবস্থাপনা কাঠামোর।
একটি খাদ্যে নিরাপদ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রের জন্য উৎপাদন, উন্নয়ন ও বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনা করা জরুরি। এ কারণেই স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থাপনা এবং সে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদক, উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ ও অভিগম্যতাও খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত। কেবল কৃষি ও কৃষি উপকরণাদি নয়, পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদ, তথ্যপ্রবাহ, যোগাযোগ, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণসহ গণতান্ত্রিক বাতাবরণে দেশের সকল মানুষের অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাকেও নিশ্চিত করতে হবে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য। দেশের জন্য কিছু 'হধঃরড়হধষ ংধভব মঁধৎফ'র ভিত্তিতে নীতিমালা বিবেচনা করা যেতে পারে। নেওয়া যেতে পারে আইনি উদ্যোগ। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যেমন ভারত ও নেপাল এ ধরনের কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে; প্রয়োজন তা বিবেচনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় বিস্তৃত নীতিমালা গ্রহণ করেছে। খাদ্য অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং সনদগুলোতে স্বাক্ষর করেছে; অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে উদ্ভিজ, প্রাণিজ ও লোকায়ত জ্ঞানকে সংরক্ষণের। গ্রহণ করেছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। ২০০০ সালের সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা এবং ১৯৯৬ সালের ওয়ার্ল্ড ফুড সামিটের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সরকার কিছু কৌশল নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ফুড অ্যাকশন প্লান (২০০৮-১৫), বাংলাদেশ ফুড সিকিউরিটি কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্লান। কিন্তু জাতীয় বাজেটে কৃষির জন্য বাজেট অতিসামান্য (৭.৫ শতাংশ), যেখানে দেশের শ্রমশক্তির শতকরা ৬৬ ভাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে জড়িত। প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের বৈপরীত্য স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে; বিপন্ন করে খাদ্য নিরাপত্তা।
খাদ্য নিরাপত্তাকে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। কেবল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বা ধান উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। মানুষের কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সম্পদ ও সেবার অধিকারের সঙ্গে এর আন্তঃসম্পর্ককে দেখতে হবে। অন্যদিকে দেখতে হবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। বিশ্ব খাদ্য মন্দার অর্থনৈতিক মন্দাকে কাজে লাগিয়ে দেশে কালোবাজারি ও গুদামজাতকরণের অসাধু উদ্যোগকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আজ বিশ্ব খাদ্য দিবসে তাই আমাদের আহ্বান সবার জন্য মানবাধিকারভিত্তিক খাদ্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।

ফারহাত জাহান : গবেষক
farhat718@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.