খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় নিষ্ফল আরেকটি বছর by মেহেদী হাসান

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ এখনো সাফল্যের মুখ দেখেনি। এ সময়ে খুনিদের কাউকে সরকার ফিরিয়ে আনতে পারেনি, ফেরত পাওয়ার সুস্পষ্ট আশ্বাসও মেলেনি। এ ক্ষেত্রে নিষ্ফল আরো একটি বছর পার করল সরকার।


জানা গেছে, গোয়েন্দারা পলাতক খুনিদের সম্ভাব্য অবস্থান নিশ্চিত করলেও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। এর পরও সরকার খুনিদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা করছেন, সবার সম্মিলিত চেষ্টায় খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল বিপথগামী একদল সেনাসদস্য। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর পলাতক অন্য খুনিদের ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেয় সরকার। সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, একই পরিণতির আশঙ্কায় ছয় খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন। পলাতক খুনিরা হলেন লে. কর্নেল (বরখাস্ত) নূর চৌধুরী, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন। তাঁদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অন্য খুনিদের অবস্থান নিশ্চিত করা না গেলেও সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, তাঁরা ভারত বা পাকিস্তানে থাকতে পারেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ সরকার সাম্প্রতিক সময়ে নূর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছে। দেশ দুটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও উঠেছে বিষয়টি। নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সরকার কানাডায় লবিস্ট নিয়োগ করেছে। জানা গেছে, নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠালে বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আশঙ্কা থাকায় কানাডা সরকার তাঁকে ফেরত পাঠাতে আগ্রহী নয়। তা ছাড়া নূর চৌধুরী ওই আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে কানাডায় আইনি আশ্রয় চেয়েছেন। এরপরও নূর চৌধুরীকে ফেরত পেতে বাংলাদেশ সরকারের জোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত বছর ৫ অক্টোবর কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ডকে চিঠি পাঠিয়েছেন। তবে ওই বছরেরই ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডা. দীপু মনির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানো প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, 'তিনি (দীপু মনি) ওই ইস্যুটি তুলেছিলেন। আমিও তা আমার সরকারের কাছে তুলব। অবশ্য এ ব্যাপারে আমার সরকারের সুস্পষ্ট একটি নীতি আছে। আর তা হলো, মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা চালু আছে এমন কোনো দেশের কাছে আমরা কাউকে সমর্পণ করতে পারি না।'
জানা গেছে, নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের অংশ হিসেবে কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশন তাঁর নামে ইস্যু করা পাসপোর্ট বাতিল করে। নূর চৌধুরী বর্তমানে আরসিএমপির একটি দলের নজরদারিতে রয়েছেন। শরণার্থী হিসেবে বসবাসের জন্য তাঁর আবেদন এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, নূর চৌধুরীকে ফেরত পাওয়ার অনুরোধ প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশ-কানাডা সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় সম্পর্কে চলছে শীতলতা। কানাডায় বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসান গত ৩১ জুলাই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করলে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে রাষ্ট্রপতি আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে খুনি এ এম রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পেতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিলেও ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো উত্তর আসেনি বলে জানা গেছে।
লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠাতে দেশটির হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চৌধুরী এ এম রাশেদ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাকে হত্যা করেন। একই বছরের ৩ নভেম্বর ওই গ্রুপটি বাংলাদেশের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং সাবেক দুই মন্ত্রী এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে কারাগারে আটক অবস্থায় হত্যা করে। রাশেদের বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার ধানমণ্ডি থানায় দণ্ডবিধির ১২০(বি), ৩০২, ৩২৪, ৩০৭, ১০৯ এবং ৩৪ নম্বর ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২ আগস্ট মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর লালবাগ থানায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারাতেও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৯৯৬ সালের ৯ আগস্ট চৌধুরী এ এম রাশেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার সোনাইমুরি গ্রামের মৃত শিহাব উদ্দিন আহমদের ছেলে চৌধুরী এ এম রাশেদ উল্লিখিত অপরাধের কারণে বাংলাদেশের ওয়ান্টেড আসামি। তাঁকে ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে ওই চিঠি দেওয়া হলেও এ ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। একই অবস্থা অন্য খুনিদের বেলায়ও।
সরকারের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, খুনি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন ২০০২ সালে। খন্দকার আবদুর রশিদ লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির আশ্রয়ে ছিলেন। লিবিয়ার বেনগাজিতে গাদ্দাফি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যবসাও ছিল তাঁর। কিন্তু গত বছর লিবিয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খুনি রশিদ এখন কোথায় আছেন তা এখন স্পষ্ট নয়। শরিফুল হক ডালিম বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। বাকিরা বারবার নিজেদের অবস্থান পাল্টাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ধারণা।
ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারতে পালিয়ে ছিলেন বলে সরকার মনে করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়টি উঠেছে। ভারত ওই খুনিদের অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের কাছে আরো তথ্য চেয়েছে। কিন্তু এরপরও সেখানে তাঁদের অবস্থান বা সমর্পণ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো খবর জানা নেই সংশ্লিষ্টদের।
খুনি ডালিম ২০০৯ সালের শেষ দিকে কানাডায় গিয়েছিলেন বলে দেশটির সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, কানাডা থেকে কয়েক দিন পরই তিনি হংকং হয়ে আবার পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনতে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স কাজ করছে। ওই টাস্কফোর্সে আরো আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, আইন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। টাস্কফোর্স ছাড়াও বিদেশে বাংলাদেশ মিশন খুনিদের ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে ৩৬ বছর সময় লেগেছে। খুনিদের দ্রুত ফিরিয়ে এনে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'খুনিদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক ও আইনি সব প্রচেষ্টাই চালানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।' তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
যেভাবে দেশ ছেড়েছিলেন খুনিরা : ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের পরের দিন বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিশেষ বিমানে রেঙ্গুন হয়ে থ্যাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পাকিস্তান সরকারের পাঠানো বিশেষ বিমানে তাঁদের লিবিয়া পাঠানো হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন ১২ খুনিকে চাকরি দেওয়া হয় বিভিন্ন দূতাবাসে। নূর চৌধুরী নিয়োগ পান ইরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে। এরপর তিনি ব্রাজিলে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ সরকারের সময় তাঁকে আলজেরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বেশ কিছু দিন জার্মানিতে অবস্থানের পর এই খুনি অনেক দেশ ঘুরে কানাডায় গিয়ে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। কানাডায় বাংলাদেশ দূতাবাস ২০০৭ সালে নূর চৌধুরীর নামে পাসপোর্ট ইস্যু করে। সে সময় কানাডায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন খন্দকার মোশতাকের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে রফিকুল ইসলাম টিপু।

No comments

Powered by Blogger.