লবণ আমদানির সুবিধা তিন ব্যবসায়ীর পেটে-* শুল্ক ফাঁকি দিতে মূল্যে চুরি * ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা -* বাজারে দাম কমেনি by আবুল কাশেম

চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের তিন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে লবণের বাজার। তাদের অসাধু কার্যকলাপে ব্যর্থ হয়ে গেছে সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে আমদানি উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত। বিষয়টি তদন্তে শেষ পর্যন্ত কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।


চাষিরা ২০১০ সালে তাঁদের উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা দরে। গত বছর সরকার তা নির্ধারণ করে দেয় চার টাকা কেজি। এ বছরও চাষিরা কমবেশি ওই দামেই লবণ বিক্রি করেছেন। অথচ এই সময়কালেই বাজারে লবণের দাম থেকেছে ২০ থেকে ২২ টাকা। আর গত মে মাস থেকে সেই লবণের দাম উঠে যায় ৩৫ টাকায়। অথচ মিল মালিকদের দুই টাকা, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কেজিপ্রতি দুই টাকা লাভ দিয়ে হিসাব করে ট্যারিফ কমিশন বলছে, ভালো মানের খাবার লবণের সর্বোচ্চ খুচরা দাম হতে পারে ২১ টাকা ৬৪ পয়সা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে চার টাকা দরে কেনা লবণ পরিশোধনের ফাঁকে ভোক্তার পকেট কাটার সুযোগ নেন মিল মালিকরা।
দেশের চাষিরাই প্রয়োজনীয় লবণ উৎপাদনে সক্ষম বলে আমদানি ও শিল্পনীতিতে এত দিন লবণ আমদানি নিষিদ্ধ ছিল। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বক্তব্য, এ বছর চাহিদার চেয়ে প্রায় ৭০ হাজার টন কম লবণ উৎপাদন হলেও মিয়ানমার থেকে লবণ পাচার হয়ে আসে বলে আমদানির প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিসিকের এই হিসাব মানেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মিল মালিকরা লবণের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার পরও বাজার নিয়ন্ত্রণের পথে না হেঁটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়। এতে রসদ জোগায় শিল্প মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যুক্তি ছিল, আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়ালে বাজারে লবণের দাম কমবে। বাস্তবে দাম কমেনি। উল্টো আমদানির কারণে চাষিরা মার খেয়েছেন। দাম কম দেখিয়ে আমদানির কারণে সরকারও বঞ্চিত হয়েছে রাজস্ব থেকে। লাভবান হয়েছে একটি সিন্ডিকেট। আর মিলগুলোর বরাবরের মতোই খোঁড়া যুক্তি- 'বেশি দামে কিনেছি, তাই বেশি দামেই বিক্রি করছি।'
গত ৬ আগস্ট পর্যন্ত দুই লাখ ৮০ হাজার টন লবণ আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে। দেশে এসেছে ৯২ হাজার টন। এতেও গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। চট্টগ্রামের কোহিনূর ও পারভেজ এবং নারায়ণগঞ্জের পরিতোষ বাবু নামের তিন ব্যবসায়ী এসব লবণ আমদানি করেছেন। আড়াই টাকা কেজি দরে কেনা লবণ দেশের মিল মালিকদের কাছে তাঁরা বিক্রি করেছেন আট টাকা দরে। দাম কম দেখিয়ে তাঁরা শুল্কও ফাঁকি দিয়েছেন। বর্তমানে এই তিন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে পুরো লবণ বাজার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, প্রতি মাসে ভোজ্য লবণের চাহিদা ৭০ হাজার টন। আমদানির ৬০ হাজার টন লবণ ইতিমধ্যে বাজারে চলে গেছে। অথচ দাম কমেনি। লবণের দাম ২০ টাকায় নামিয়ে আনতে না পারার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে লবণ আমদানির এই সিন্ডিকেট খুঁজে বের করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করেছে। দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ঈদের পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ব্যবসায়ী পরিতোষ-পারভেজ-কোহিনূর সিন্ডিকেটের সঙ্গে ভারতের লবণ রপ্তানিকারকদের রয়েছে বিশেষ যোগাযোগ। সরকার লবণ আমদানি উন্মুক্ত করার পর মিল মালিকরা লবণ আমদানির জন্য ভারতের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ওই তিন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ঋণপত্র খোলার পরামর্শ দেয়। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মিল মালিক যে দুই লাখ ৮০ হাজার টন লবণ আমদানি করেছেন তার মধ্যে দুই লাখ ৭০ হাজার টনের এলসিই খোলা হয়েছে ওই তিন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। এর মধ্যে নিজের চারটি মিল থাকায় ৪০ হাজার টন লবণ আমদানির বৈধ সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন পরিতোষ। বাকি দুজন আমদানি করেছেন দুই লাখ ৩০ হাজার টন লবণ। বাকি ১০ হাজার টন লবণ সরাসরি আমদানি করেছে এসিআই।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, এলসি খোলা দুই লাখ ৮০ হাজার টন লবণের মধ্যে ৯২ হাজার টন দেশে এসেছে। ভারতের বাইরে কোনো দেশ থেকে আমদানির জন্য এলসি খোলেননি ওই তিন ব্যবসায়ী। সব এলসির ক্ষেত্রেই লবণের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ৩০ ডলার। অথচ ভারতে প্রতিটন লবণের রপ্তানি মূল্য ৪০ ডলার। এসিআই কম্পানিও ৪০ ডলার দরে ভারত থেকে লবণ এনেছে। মূলত লবণ আমদানির ওপর ৯১ দশমিক ৮৮ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এটা ফাঁকি দিতেই দাম কম দেখানো হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানতে পেরেছে, শুল্ক ফাঁকি ও আমদানি করে সরবরাহ বাবদ মিলগুলো থেকে ওই তিন ব্যবসায়ী টনপ্রতি পাঁচ ডলার করে মুনাফা নিয়েছে।
বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন লবণ নিয়ে দিনকয়েক আগে কালের কণ্ঠের কাছে নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'পর্যবেক্ষণের পরও একটি পণ্যের মূল্য মানুষের প্রত্যাশার মধ্যে নামিয়ে আনতে পারিনি। তা হলো লবণ। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী লবণের দাম ১৫-১৬ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকার মধ্যে থাকা উচিত।' তিনি বলেন, একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ২ টাকা ৮০ পয়সা দরে কেনা লবণ কয়েকটি বড় কম্পানির কাছে ৮ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি করেছেন। অথচ আইন অনুযায়ী, অপরিশোধিত লবণ যিনি আমদানি করেছেন তাঁরই পরিশোধন করে বাজারজাত করার কথা। আমদানির কয়েক দিনের ব্যবধানে বিক্রি করে দুই-তিন টাকার লবণ ৮-১০ টাকায় বিক্রি করে কেউ কেউ বহু টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সচিব বলেন, 'ইতিমধ্যে একজন ব্যবসায়ীকে আমরা শনাক্ত করেছি। আরো কেউ থাকলে তাঁদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা আইন, অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণ আইনসহ ফৌজদারি আইনেও মামলা করা হতে পারে।'

No comments

Powered by Blogger.