পুলিশ ও নেতাদের নামে ফুটপাতে চাঁদাবাজি by নজরুল ইসলাম ও কাজী আনিছ

রাজধানীর ফুটপাতের হকার ও খুদে দোকানিরা ব্যাপক চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নামে এই চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর ঈদের সময় চাঁদার পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
ছিন্নমূল হকার সমিতি ও হকার্স লীগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে ফুটপাতের হকারের সংখ্যা এক লাখের বেশি। ঈদের সময় এ সংখ্যা আরও বাড়ে।
বাংলাদেশ হকার্স লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এম এ কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজেরা সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছায়ায় থাকে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের নামে চাঁদা তুলে থাকে ‘লাইনম্যান’ নামধারী এক শ্রেণীর সন্ত্রাসী। এসব সন্ত্রাসীর তালিকা করে তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) মো. আবদুল জলিল মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, হকাররা অবৈধভাবে ফুটপাত দখল করে রেখেছে। তবু চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাতের হকার নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘ভাই, ঈদে চাঁদা একটু বেশি দিতে হইতেছে। এক লাখ টাকা পজেশন কিনছি। প্রতিদিন পুলিশরে দেই এক শ আর মাস শেষে ‘লাইনম্যান’ সামাদকে দেই ১৫ হাজার টাকা।’
হকারদের অভিযোগ, মিরপুর রোডের নীলক্ষেত থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় পর্যন্ত এলাকার ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজ শাখার সাবেক এক নেতা। তাঁর অধীনে সড়কটির পশ্চিম পাশে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন জনৈক সামাদ। আর পূর্ব পাশের ফুটপাতে চাঁদা তোলেন ‘লাইনম্যান’ রফিক। নিউমার্কেটের সামনে ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের স্থানীয় কতিপয় নেতা। নিউমার্কেট ও মিরপুর রোডে চাঁদাবাজি তদারক করতে ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজ শাখার কিছু কর্মী নিয়মিত টহল দেন।
আজিমপুর থেকে ইডেন কলেজের সামনের সড়কের ফুটপাতে ভাসমান দোকানগুলো থেকে পুলিশ চাঁদা তোলে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখানকার প্রত্যেক দোকানিকে দৈনিক ২৫ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার এলাকা থেকে সুন্দরবন স্কয়ার পর্যন্ত ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগের স্থানীয় এক নেতা। এই এলাকায় ফুটপাতে দোকানের স্থান বরাদ্দ (পজেশন) নিতে যুবলীগের ওই নেতাকে ২৫ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। তাঁর পক্ষে সন্ত্রাসী বাবুল, নূরু মিয়া, সেলিম, শহীদ ও জাহিদ দোকানপ্রতি দৈনিক ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখানে চাঁদা আদায়কারীরা ‘ফুট লিডার’ হিসেবে পরিচিত।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনের সড়ক ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন কাশেম নামের এক ব্যক্তি। এখানকার একজন হকার বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগ করি। ঈদ মৌসুমে বড় ভাইয়েরা এখানে দোকান বসাইতে দিছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাশেম ভাই আইসা এক শ টাকা লইয়া যায়, আর পুলিশরে দিই প্রতিদিন ৫০ টাকা করে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার নুরুল ইসলাম বলেন, ফুটপাতের চাঁদাবাজদের আইনের আওতায় আনা হবে। লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদের ধরিয়ে দিতে হকারদের তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। এ ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকলেও তা-ও তাঁকে জানাতে বলেন।
মিরপুর ১ নম্বরে শাহ আলী শপিং কমপ্লেক্সের সামনের হকার মোতালেব হোসেন জানান, রিকশা-ভ্যানের ওপর তৈরি পোশাকের ভাসমান দোকান বসাতে তিনি এককালীন দিয়েছেন ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া তাঁকে প্রতি মঙ্গলবার ১৫০ টাকা, সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে ৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। তবে কে বা কারা এ চাঁদা নেন, ভয়ে তাঁদের নাম বলতে রাজি হননি তিনি।
তবে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা মিরপুরে বিভিন্ন ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। চাঁদা আদায় করতে তাঁরা একাধিক কমিটি করেছেন।
মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের পাশ থেকে গ্যালাক্সি হাসপাতাল পর্যন্ত ফুটপাতে শতাধিক হকার বসে। এখান হকার বাবুল মিয়া জানান, তাঁর কাছ থেকে প্রতিদিন ‘লাইনম্যানরা’ পুলিশ ও ‘কমিটির’ জন্য ৪০ টাকা করে নিয়ে যায়। আরেক হকার রিয়াজ জানান, ৪০ টাকা করে না দিলে পুলিশ তাঁদের বসতে দেয় না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ছিন্নমূল হকার্স লীগের তালিকা অনুযায়ী, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে শাহ আলী মার্কেটের সামনের ফুটপাতে মনির, লোকমান ও জুয়েল, ফলপট্টি এলাকায় বীনা, মিরপুর ১ নম্বরে শাহ আলী মার্কেটের সামনে আবদুল হান্নান, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের সামনে মো. জুয়েল, মিরপুর কো-অপারেটিভ মার্কেটের সামনে শাহ আলম, বাসস্ট্যান্ডের সামনে গিয়াসউদ্দিন এবং পল্লবীর পূরবী সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতে মোস্তফা ও মাসুদ চাঁদা আদায় করেন। একই তালিকায় বলা হয়, নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট ও বলাকা সিনেমার আশপাশে আবদুস সাত্তার, বাবুল, হোসেন, শাহাদাত ও তাঁর সহযোগীরা; ধানমন্ডি সুপার মার্কেটের সামনে রফিক ও তাঁর সহযোগীরা; ফার্মগেট ও ইন্দিরা রোড এলাকায় শাহ আলম ও মকবুল হোসেন; পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজার গলিতে সেকান্দার আলী; দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে সোনা মিয়া, জুলমত আলী, তোরাব মিয়া এবং উত্তর যাত্রাবাড়ীতে সিরাজ মিয়া, রফিক হোসেন ও নূরু মিয়া চাঁদা আদায় করে।

No comments

Powered by Blogger.