গণমাধ্যম- অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে কেন এই যুদ্ধ? by মশিউল আলম

উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে ইকুয়েডরের সঙ্গে ব্রিটেন ও সুইডেনের কূটনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইকুয়েডরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিকার্দো পাতিনো অ্যাসাঞ্জকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ স্টকহোমে ইকুয়েডরের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, ইকুয়েডর সুইডেনের আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।


ইকুয়েডর সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তারা রাজনৈতিক পীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্তকারী একজন ব্যক্তির মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের চেষ্টা করছে মাত্র। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেইগও ইকুয়েডরের সিদ্ধান্তে হতাশা ব্যক্ত করে বললেন, অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য কূটনৈতিক সুরক্ষা ব্যবহার করা উচিত নয়। অবশ্য ইকুয়েডরের এই সিদ্ধান্তে অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনে পাঠানোর ব্যাপারে ব্রিটেনের অবস্থানের কোনো নড়চড় হবে না। তাঁকে অবশ্যই প্রত্যর্পণ করা হবে এবং অ্যাসাঞ্জ লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে বেরোলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে—এসব কথাও পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যাসাঞ্জ কীভাবে সশরীরে ইকুয়েডরে পৌঁছাবেন? সে রকম কোনো পথ কি খোলা আছে? ইকুয়েডর এখন অ্যাসাঞ্জকে একটি কূটনৈতিক পাসপোর্ট দিতে পারে। কিন্তু সে রকম পাসপোর্ট বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে; সে দেশের আইন থেকে অব্যাহতি দিতে পারে না। এই অবস্থায় ইকুয়েডর অ্যাসাঞ্জকে কোনো কূটনৈতিক পদে নিয়োগ দিতে পারে। তাহলে ভিয়েনা কনভেনশনের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে তাঁর বিচার-প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কথা। কোনো কূটনীতিককে গ্রেপ্তার বা আটক করা যায় না। কিন্তু সমস্যা হলো, এ মুহূর্তে অ্যাসাঞ্জের আইনি মর্যাদা হলো ‘পলাতক আসামি’। জামিনাদেশের শর্ত লঙ্ঘন করে তিনি পালিয়ে লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন ইকুয়েডর যদি তাঁকে ব্রিটেনে তাদের দূতাবাসের একজন কূটনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয় তাহলে ব্রিটেন বলবে, তাদের আইনি পদক্ষেপ এড়ানোর উদ্দেশ্যেই ইকুয়েডর অ্যাসাঞ্জকে কূটনীতিক পদে নিয়োগ দিয়েছে। এই যুক্তি দেখিয়ে ব্রিটেন ইকুয়েডরের একজন কূটনীতিক হিসেবে অ্যাসাঞ্জের নিয়োগে অনুমোদন না-ও দিতে পারে। অর্থাৎ ব্রিটেন অ্যাসাঞ্জকে ইকুয়েডরের কূটনীতিক হিসেবে গ্রহণ না করলে তাঁকে গ্রেপ্তার, আটক ও সুইডেনে প্রত্যর্পণ করার আইনগত এখতিয়ার ব্রিটেনের অটুট থাকবে। ব্রিটেন যখন জোর দিয়ে বলছে যে অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনে প্রত্যর্পণ করতে তারা আইনগতভাবে বদ্ধপরিকর, এবং তারা তা-ই করবে, তখন ইকুয়েডরের কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ পেলেও অ্যাসাঞ্জ তাদের দূতাবাস থেকে বের হতে পারবেন না।
তাহলে আর কী উপায় থাকল? ইকুয়েডর দূতাবাসের কর্মকর্তারা অ্যাসাঞ্জকে কূটনৈতিক বাহনে করে বিমানবন্দরে নিয়ে যেতে পারেন। আইন অনুযায়ী, কোনো কূটনৈতিক বাহন তল্লাশি করা যায় না; ব্রিটিশ পুলিশ অ্যাসাঞ্জকে বহনকারী কূটনৈতিক বাহন তল্লাশি করতে পারবে না। কিন্তু বিমানবন্দরে পৌঁছার পর তো তাঁকে সেই বাহন থেকে নেমে উড়োজাহাজে উঠতে হবে। এই মাঝখানের ফাঁকটুকুতেই তিনি ব্রিটেনে ‘পলাতক আসামি’ হিসেবে ব্রিটিশ আইনের অধীন হবেন, স্পষ্টতই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করবে।
ইকুয়েডর দূতাবাসের কর্মকর্তারা অ্যাসাঞ্জকে তাঁদের কূটনৈতিক ব্যাগে ভরে পাচার করার উদ্যোগও নিতে পারেন। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কোনো কূটনৈতিক ব্যাগ (বস্তা নয়, একটা বাক্স বা বড় কনটেইনারও হতে পারে) খোলা বা আটকে রাখা যায় না। কিন্তু স্ক্যানিং বা থার্মাল ইমেজিংয়ের সাহায্যে কূটনৈতিক ব্যাগের ভেতরের জিনিসপত্র দেখার বিধান আছে। সে ক্ষেত্রে ব্যাগের ভেতরে অ্যাসাঞ্জের অবস্থান ধরা পড়বে, তখন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কূটনৈতিক ব্যাগ খুলতে পারবে। অর্থাৎ অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তার এড়ানোর কোনো পথ দৃশ্যত খোলা নেই। তবে গত বুধবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে রকম আভাস দিয়েছিল যে ব্রিটিশ পুলিশ অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করতে দূতাবাসের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইগের সর্বশেষ কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, তারা সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। দূতাবাসে হানা দিয়ে অ্যাসাঞ্জকে পাকড়াও করে সুইডেনে পাঠানোটা ভালো দেখাবে না—এটা সম্ভবত ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেছে।
কিন্তু একটা প্রশ্ন ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে: ব্রিটেন কেন অ্যাসাঞ্জকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে এবং সুইডেন কেন তাঁকে পেতে এমন মরিয়া আচরণ করছে? দুটি দেশই বারবার আইনের দোহাই দিচ্ছে। পশ্চিমা মূলধারার সংবাদমাধ্যমও প্রধানত আইনের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বলতে চাইছে, অ্যাসাঞ্জ তাঁর জামিনের শর্ত ভেঙে পালিয়ে ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়ে ঠিক করেননি, তিনি ইকুয়েডরের রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতেও পারেন না, কারণ তিনি কোনো শরণার্থী নন, বরং ধর্ষণের মতো গুরুতর ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনি যদি নির্দোষ হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর উচিত সুইডেন গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়া। বড় বড় সরকার আর বড় বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ আইনভক্ত হয়ে উঠেছে। তারা অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর শেষ আশ্রয়দাতা ইকুয়েডরের কাছ থেকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ দাবি করছে।
কিন্তু অ্যাসাঞ্জের পক্ষে আইনের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এখন সম্ভব নয়। তিনি জানেন, যৌন অসদাচরণের অভিযোগ ছুতো মাত্র; এসবের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চূড়ান্তভাবে তাঁকে সে দেশেই পাঠানো হবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেবে। তাঁর এসব আশঙ্কার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পেয়েছে ইকুয়েডর কর্তৃপক্ষ। অ্যাসাঞ্জকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে তারা প্রায় দুই মাস সময় নিয়েছে অকারণে নয়। প্রথমে তারা সুইডিশ কর্তৃপক্ষকে বলেছে, লন্ডনে এসে তারা ইকুয়েডরের দূতাবাসে অ্যাসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদ করুক। কিন্তু সুইডেন তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
লক্ষ করার বিষয়, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে স্টকহোমে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে ২০১০ সালের ২০ আগস্ট। সে সময় তিনি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর মামলাটি গুরুত্বহীন বলে স্থগিত করা হয়। তার পরেও অ্যাসাঞ্জ সুইডেনে ছিলেন আরও এক মাস সাত দিন। সে সময়ের মধ্যে সুইডিশ প্রসিকিউশন কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডাকেনি। ২৭ সেপ্টেম্বর (২০১০) তিনি বৈধ পথে সুইডেন থেকে লন্ডন আসার কয়েক সপ্তাহ পর তারা অ্যাসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছে। তখন অ্যাসাঞ্জ প্রস্তাব দিয়েছিলেন, টেলিফোন বা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবেন, কিন্তু সে প্রস্তাব সুইডেন প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইকুয়েডর সরকার আমেরিকার কাছেও জানতে চেয়েছে, অ্যাসাঞ্জকে সুইডেন থেকে আমেরিকা প্রত্যর্পণ করা হলে অ্যাসাঞ্জ সেখানে গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের অধীনে বিচারের মুখোমুখি হবেন না—এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে কি না। আমেরিকা সে রকম কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। অ্যাসাঞ্জের গোয়েন্দা যোগাযোগ অত্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর কাছে তথ্য আছে, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁকে গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের আওতায় বিচার করার জন্য একটি গ্র্যান্ড জুরি গোপনে কাজ করছে। তা ছাড়া গোপনীয় তথ্য পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার মার্কিন সেনা ব্র্যাডলিং ম্যানিংয়ের সঙ্গে অ্যাসাঞ্জের যোগসূত্রের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র উইকিলিকসের কয়েকজন সক্রিয় কর্মীর টুইটার অ্যাকাউন্টের তথ্য নিয়েছে। উইকিলিকসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজন আমেরিকান হ্যাকার-ক্রিপ্টোগ্রাফারের ওপর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন নজরদারি চলছে। এসব মিলিয়ে ইকুয়েডর কর্তৃপক্ষ অ্যাসাঞ্জের আশঙ্কার বাস্তব যুক্তি উপলব্ধি করেই তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমেরিকায় অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের অধীনে মামলা করা হলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। কারণ, সে আইনে সর্বোচ্চ দণ্ড সেটাই। এমন বিপদের মুখোমুখি একজন ব্যক্তি যখন ইকুয়েডরের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন, তখন তাঁকে তা দেওয়া ইকুয়েডর কর্তব্য বলে মনে করছে। কিন্তু তাতে অ্যাসাঞ্জের আইনগত অবস্থা ও ভৌত অবস্থানের আশু পরিবর্তনের কোনো আভাস নেই। তাঁকে হয়তো আরও দীর্ঘ সময় লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে অন্তরীণ থাকতে হবে।
তবে এটা মন্দের ভালো। ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর কঠোর শর্ত সাপেক্ষে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এ বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত গৃহবন্দী অবস্থায় অ্যাসাঞ্জকে যে ১৮ মাস কাটাতে হয়েছে, এ দীর্ঘ সময় তিনি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেননি। এখন ইকুয়েডরের দূতাবাসে তিনি সার্বক্ষণিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। এক অর্থে গোটা পৃথিবী এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। মেলবোর্নের কম্পিউটার হ্যাকার-ক্রিপ্টোগ্রাফার-সাইফারপাংক থেকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, মুক্তচিন্তা, মুক্তপ্রকাশ ও ন্যায়বিচারের পক্ষে লড়াকু সংগ্রামীতে রূপান্তরিত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ আবার হয়তো ফিরে যাবেন তাঁর কৈশোর-তারুণ্যের সেই আলো-আঁধারি ভূতলে (কম্পিউটার আন্ডারগ্রাউন্ড), যেখানে ফেলে এসেছেন ইলেকট্রনিক নাশকতার রোমাঞ্চকর অভিযানগুলোর স্মৃতি।
 মশিউল আলম: সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.