এ্যালজেবরার কী দরকার আছে? ॥ মূল : এন্ডু হ্যাকার- অনুবাদ : এনামুল হক

(গতকালের পর) মৌলিক সংখ্যাগত দক্ষতা অবশ্যই অর্জন করতে হবে যেমন ডেসিমেল, অনুপাত হিসাবকরণ ইত্যাদি। গণিতশাস্ত্র ভাল জানা থাকলে সেই দক্ষতা শাণিত হয়। তবে জর্জটাউন সেন্টার অন এডুকেশন এ্যান্ড ওয়ার্কফোর্সের এক বিশ্লেষণেন পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে যে সামনের দশকে প্রারম্ভিক স্তরের কর্মীদের শতকরা মাত্র ৫ জনের বীজগণিত বা তার উপরের কোন বিষয়ে দক্ষতা থাকতে হবে।
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পিটার ব্রাউন ফেল্ড তাঁর ছাত্রদের বলেন: “গণিত না থাকলে আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।” তিনি নিতান্তই সঠিক কথা বলেছেন। বীজগণিতের সূত্রগুলোই এ্যানিমেটেড ছায়াছবি, বিনিয়োগ কৌশল এবং এয়ারলাইন টিকেটের দাম নির্ধারণে মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
পরিমাণাত্মক জ্ঞান সকল ধরনের সরকারী নীতি যাচাই ও পরিমাপ করে রাখার ব্যাপারে স্পষ্টতই প্রয়োজনীয়। সংখ্যার পেছনে ক্রিয়াশীল আদর্শ নির্ণয় ও চিহ্নিত করতে পারা স্বভাবতই প্রয়োজন। আমাদের যুগ দ্রুত পরিসংখ্যানের যুগে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে নাগরিকদের ওয়াকিবহাল থাকার পরিসীমা উন্নীত হয়েছে। প্রয়োজন যেটা সেটা পাঠ্যবইয়ের ফর্মুলা না বরং সংখ্যাগুলো কোত্থেকে আসে এবং সেগুলোর দ্বারা প্রকৃতপক্ষ কি প্রকাশ পায় সে সম্পর্কে বৃহত্তর ধারণা লাভ।
গণিত আমাদের মনকে শাণিত করে এবং ব্যক্তি হিসাবে ও নাগরিক সম্প্রদায় হিসেবে আমাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবে আরও বেশি সুদক্ষ করে তোলে এমন দাবি সম্পর্কে কি বলা যায়? এ কথা সত্য যে, গণিতের জন্য মানসিক ক্লেশ ও প্রয়াস দরকার। তবে (ী২ +ু২)২ = (ী২থ ু২) + (২ীু)২ প্রমাণ করতে পারলেই যে আরও বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক মত বা সামাজিক বিশ্লেষণ বেরিয়ে আসবে তার কোন প্রমাণ নেই। পশুরোগের টেকনিশিয়ানদের সনদপত্র কোর্সের জন্য বীজগণিতের প্রয়োজন। অথচ আমার দেখা এই পেশার গ্র্যাজুয়েটদের কেউ-ই তাদের রোগীর রোগনির্ণয় বা চিকিৎসায় বীজগণিত কখনও ব্যবহার করেননি। হার্ভার্ড ও জন হপকিনসের মতো মেডিক্যাল স্কুলগুলো সকল আবেদনকারীর ক্যালকুলাসের জ্ঞান জানতে চায় যদিও ক্লিনিক্যাল পাঠ্যক্রমে ক্যালকুলাসের কোন স্থান নেই, পরবর্তী পর্যায়ের চিকিৎসাচর্চার ক্ষেত্রে ক্যালকুলাসের প্রশ্ন তো উঠেই না। বাইরের মানুষদের মনে প্রভাব বিস্তার করা এবং কোন পেশার মর্যাদা উন্নীত করার জন্য গণিতশাস্ত্রকে একটা তকমা, একটা ব্যজ, একটা টোটেম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ক্যালটেক ও এমআইটি কেন প্রত্যেককে গণিতে দক্ষ হতে বলে অনুধাবণ করা কঠিন নয়। তবে এটা দেখতে পাওয়া সহজ নয় কেন সম্ভাবনাময় কবি ও দার্শনিকরা গণিতের ক্ষেত্রে সুউচ্চ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। বীজগণিত রপ্ত করতে বলা হলে প্রকৃতপক্ষে একজন ছাত্রের শরীরকে তির্যক করে তোলা হয়। তাতে যে অপরিহার্যরূপে ভাল হয় এমন নয়।
আমি একটা ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে শেষ করতে চাই। বিশুদ্ধ ও ফলিত উভয় ধরনের গণিতই আমাদের সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তা সেটা নান্দনিক জগত হোক অথবা ইলেক্ট্রনিক জগত হোক। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের অধিকাংশ যতটা না গণিতকে বুঝে তার চেয়ে বেশি ভয় পায় বা সমীহ করে। আমাদের জনগণের সিংহভাগের অধিকতর কিছু অর্জনের পথে যে বিষয়টি অন্তরায়স্বরূপ তার পেছনে আমাদের এত বেশি একাডেমিক এনার্জি নিয়োগ না করে বরং আমার প্রস্তাব হলোÑআসুন আমরা বিকল্প কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করি। এভাবে প্রতিটি পর্যায়ের গণিতের শিক্ষকরা যাকে আমি বলি ‘নাগরিক পরিসংখ্যার’ তার ওপর দারুণ আকর্ষণীয় কোর্স তৈরি করতে পারেন। এ্যাডভান্সড প্লেসমেন্ট সিলেবাসের মতো। এটা তখন বীজগণিতের পেছনের দরজার সংস্করণ হবে না। কিংবা প-িত ব্যক্তিরা যখন একে অন্যের জন্য লেখেন তখন তাদের ব্যবহৃত সমীকরণের ওপরও এটা দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে না। বরং এর মধ্য দিয়ে ছাত্ররা সেই সব সংখ্যার সঙ্গে পরিচিত হবে যার দ্বারা আমাদের ব্যক্তিগত ও জনজীবন বর্ণিত হয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ নাগরিক পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে ছাত্ররা কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স কিভাবে তৈরি করতে হয় তার মধ্যে কি থাকে এবং কিভাবে সূচকের প্রতিটি আইটেমের গুরুত্ব বা মূল্য নির্ণিত হয় তা শিখতে পারবে। সংখ্যার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে গবেষণার চাহিদা জ্যামিতির মতোই বড় হতে পারে। অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক কলেজে ‘পরিমাণাত্মক বিচার- বিশ্লেষণের’ ওপর কোর্সের প্রয়োজন হচ্ছে। বস্তুতপক্ষে আমাদের সেই কোর্সটা কিন্ডারগার্টেনে শুরু করা উচিত।
আশা করি গণিত বিভাগগুলো গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস ও দর্শন এবং সেইসঙ্গে প্রাচীন সংস্কৃতিতে এর প্রয়োগের ওপরও কোর্স তৈরি করতে পারবে। শিল্পকলা ও সঙ্গীতে এমনকি কাব্যে গণিত থাকবে না কেন? সেই সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত বিজ্ঞানে এর ভূমিকাই বা থাকবে না কেন? লক্ষ্যটা হবে গণিতকে একটা উদার শিল্পকলা হিসাবে দেখা। একে ভাস্কর্য বা ব্যালে নৃত্যের মতো আয়ত্তযোগ্য ও সাদরে গ্রহণীয় করে তোলা। আমরা যদি নতুন করে চিন্তা করে দেখিÑকিভাবে গণিতশাস্ত্রের জন্ম হয়েছে, তাহলে চারদিকে সাড়া পড়ে যাবে। এবং গণিতে ছাত্রদের ভর্তির হার বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। ২০১০ সালে ১৭ লাখ ছাত্রছাত্রীকে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে মাত্র ১৫৩৯৬ জন অর্থাৎ ১ শতাংশেরও কম গণিতে স্নাতক। আমরা তরুণ জনগোষ্ঠীকে যে গণিতশাস্ত্র আত্মস্থ করতে বলি সেটাকে সম্প্রসারিত করা নয় বরং ছোট করে ফেলা অনেকগুণে ভাল হবে। হ্যাঁ তরুণ জনগোষ্ঠীকে লিখতে ও পড়তে শিখতে হবে। এবং বড় বড় ভাগ করতে সক্ষম হতে হবে। তা সেটা তারা চাক আর না-ই চাক। কিন্তু তাই বলেভেক্টোরিয়াল এঙ্গেল এবং ডিসকন্টিনিউয়াস ফাংশন আয়ত্ত করতে তাদেরকে বাধ্য করার কোন কারণ নেই।
মনে করুন গণিত এক বিশাল পাথর যা আমরা প্রত্যেককে দিয়ে টানাচ্ছি অথচ মূল্যায়ন করে দেখছি না যে এত কষ্ট করে এসব করার ফলে অর্জনটা কি হচ্ছে। সুতরাং বিকল্প বা ব্যক্তিক্রম কিছু না বের করতে পারলে কেনই বা গণিতের প্রয়োজন। এ পর্যন্ত আমি কোন বিশ্বাসযোগ্য জবাব খুঁজে পাইনি। (সমাপ্ত)

[লেখক : নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমেরিটাস অধ্যাপক। তাঁর লেখা একটি বইয়ের নাম ‘হায়ার এডুকেশন? হাউ কলেজেস আর ওয়েস্টিং আওয়ার মানি এ্যান্ড ফেইলিং আওয়ার কিডসÑএ্যান্ড হোয়াট ক্যান উই ডু এবাউট ইট।’ ওপরের নিবন্ধটা নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকায় প্রকাশিত। এখানে তা ঈষৎ সংক্ষিপ্তাকারে পরিবেশিত হলো।]

No comments

Powered by Blogger.