পোশাক শিল্পে লাগাতার অসন্তোষ-থেমে যাচ্ছে ঢাকার চাকা by পারভেজ খান

পোশাক শিল্পে চলমান অরাজকতা ও অস্থিতিশীলতার জের ধরে সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রাজধানী ঢাকা যেন এক অবরুদ্ধ নগরীতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে সড়কপথে রাজধানীর প্রবেশদরজা হিসেবে চিহ্নিত টঙ্গী-গাজীপুর, সাভার-আশুলিয়া এবং নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ক্ষণে ক্ষণে উত্তপ্ত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে।


কোনো এলাকা আজ শান্ত তো কাল হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। কোথাও জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন, কোথাও ব্যাপক হারে ভাঙচুর। সঙ্গে রাস্তা অবরোধ তো আছেই। আর এসবের পুরো নেতিবাচক প্রভাবটুকু এসে পড়ছে রাজধানীর জনজীবনে। ব্যাঘাত ঘটছে জীবনযাপনের স্বাভাবিক ধারায়। সড়কে সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক যানজট। একদিকে ঢাকা থেকে দূরপাল্লার যানবাহনগুলো যেমন সময়মতো বের হয়ে যেতে পারছে না, তেমনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা যানবাহনও ঢাকায় ঢুকতে পারছে না। সব মিলিয়ে ঢাকার চাকা প্রায়ই আটকে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত সোমবার থেকে দেখা দেওয়া নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির কারণে গতকাল শনিবার পর্যন্ত নানা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ প্রায় ২৮ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। এর ফলে সৃষ্ট ভোগান্তির মাত্রাটা অনেক বেশি। এতে যানজট বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে দ্রব্যমূল্যও। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, এমনিতেই ঢাকার যানজট নিরসনে তাদের ঝক্কি-ঝামেলার শেষ নেই। প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে এই সমস্যা সামাল দিতে। এর ওপর এখন চরম আকার ধারণ করেছে পোশাক শিল্পের মালিক-শ্রমিক বিরোধজনিত অস্থিতিশীলতা। কয়েক দিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো প্রবেশপথে ঘটছে নানান অপ্রীতিকর ঘটনা। দৃশ্যত আন্দোলন বলতে এখন যা কিছু ঘটছে, তা হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ, বেশুমার যানবাহন ভাঙচুর, নির্বিচার জ্বালাও-পোড়াও। অথচ এই সংকট উত্তরণে মালিকপক্ষের কোনো চেষ্টাই পুলিশ দেখতে পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ একাধিকবার বৈঠকও করেছে। এসব বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কাছে মনে হয়েছে, মালিকপক্ষের একগুঁয়েমির কারণেই বিরাজমান সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। গতকালও শ্রমিকরা সাভারের আশুলিয়ায় সড়ক অবরোধ করে ভাঙচুর করে। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক এবং নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়ক সকাল থেকে টানা তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকে। পরিণতিতে ওই তিন ঘণ্টাসহ পরের আরো কয়েক ঘণ্টা ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ ছিল।
একই অবস্থা চলে রাজধানীর আরেক প্রবেশ পথ কাঁচপুরেও। সকাল ৮টা থেকে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে রাখে। এরপর শুরু হয় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ। এই অবস্থা চলে বিকেল পর্যন্ত। আর এ কারণে ভোগান্তির শিকার হন হাজার-হাজার বাসযাত্রী। বেশ কয়েক ঘণ্টা ওই পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে রাজধানী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, ঢাকা থমকে থমকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। প্রায়ই অশান্ত থাকছে ঢাকার প্রবেশপথগুলো। এই সমস্যার জন্য দায়ী মূলত অপরিকল্পিত শিল্পায়ন। পৃথক সড়ক করে নির্ধারিত বেষ্টনীতে না রেখে (ইপিজেডের মতো) হাইওয়ের ধারে এভাবে গার্মেন্ট বা অন্য কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে এই সমস্যা হতেই পারে। আর বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে যেকোনো সময়ই ঢাকার চাকা বন্ধ বা অচল হয়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে এই শ্রমিক অসন্তোষ ঢাকার ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগও শঙ্কিত এবং পুলিশের বিভাগীয় বৈঠকেও এই সমস্যা নিয়ে গত কয়েক দিন আলোচনা হয়েছে বলে তিনি জানান।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন মালিকরাই। কিন্তু তাঁরা সেটা করছেন বলে মনে হয় না। বরং তাঁরা বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের পাল্টা হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত করে তুলছেন। বিশেষ করে তৈরি পোশাক মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ গত বৃহস্পতিবারই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে রবিবারের মধ্যে গোলযোগ বন্ধ না হলে তারা আশুলিয়ার সব কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেবে। বাস্তবে তার আগেই অর্থাৎ গতকালই সাংবাদ সম্মেলন করে আশুলিয়ার সব পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে তারা। সমস্যা সমাধানের পথ না বের করে এ ধরনের ঘোষণা দেওয়ার কারণে পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের আশঙ্কা বহু গুণে বেড়ে গেছে।
বিজিএমইএর পরিচালক রফিকুল ইসলাম বাবুল গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, এই ঘোষণা দেওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো পথ খোলা ছিল না। ছয় দিন ধরে তাঁরা অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে। কিন্তু তাঁদের এই প্রচেষ্টা আর ধৈর্য ধারণের কারণে শিল্পমালিকদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।
এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, গার্মেন্ট শিল্পে বিরাজমান এই পরিস্থিতির খেসারত দিতে হচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষকেই। প্রভাব পড়ছে পুলিশের ওপরও। ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। বাড়ছে যানজট। বিভিন্ন রুটের যানবাহন সময়মতো গন্তব্যের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়তে বা ঢুকতে না পারায় প্রবেশপথগুলোতে দীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে। কথায় কথায় ভাঙচুর করা হচ্ছে মূল্যবান যানবাহন। পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে আহত হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরাও।
আইজিপি বলেন, পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু কতক্ষণ? অরাজকতা বন্ধ না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ঢাকাসহ সারা দেশকে এই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে পুলিশ আরো কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
খন্দকার হাসান মাহমুদ আরো বলেন, পুলিশ তাদের মতো করে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আসলে পোশাক শিল্পের এই সমস্যা দূর করায় পুলিশের তেমন কিছু করার নেই। যদিও যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে পুলিশকেই। সুকৌশলে নানা আন্দোলনে শ্রমিকদের উসকে দেওয়া হচ্ছে। তাদের সারল্যকে ব্যবহার করছে একটি চক্র। এই চক্রের অনেককে চিহ্নিতও করা হয়েছে। শ্রমিক নামধারী এই অশুভ চক্রের সদস্যরা শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে বলে তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.