নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-বন্দর নিয়ে আপাতত স্বস্তি, কিন্তু... by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

চট্টগ্রাম বন্দরের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে। খোদ নৌপরিবহনমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই তাঁর পদত্যাগ দাবি করে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-আমদানিকারকেরা জানিয়ে দিলেন, তাঁদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।


বন্দরের কর্মকাণ্ডে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপকে এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছেন অধিকাংশ বক্তা। আশ্চর্যের বিষয়, নানা বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিরোধ থাকলেও এ বৈঠকের মাত্র এক দিন পর এক সংবাদ সম্মেলনে বন্দর শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারাও বন্দরের দুরবস্থার জন্য আঙুল তুললেন একই মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটির বিরুদ্ধে।
মন্ত্রী শাজাহান খান অবশ্য ব্যর্থতা প্রমাণিত হলে পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সেই ব্যর্থতা আর কখন এবং কী পরিস্থিতিতে প্রমাণিত হবে, সেই প্রশ্ন সরাসরি তাঁকে করেছেন ব্যবসায়ীরা। মন্ত্রী সংসদীয় কমিটির পক্ষেও সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংসদীয় কমিটি তাঁর মন্ত্রণালয়ে খবরদারি করতে পারে না। তাদের সব সুপারিশও তিনি আমলে নেন না, শুধু বন্দরের জন্য হিতকর এমন কিছু সুপারিশ তিনি গ্রহণ করেন।
মন্ত্রী অস্বীকার করলেও বেসরকারি বার্থ অপারেটর নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা এবং এর আগে দু-দুবার দরপত্র আহ্বান করেও তা বাতিল করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই সন্দেহের বীজ উপ্ত রয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারী ও শ্রমিক সংগঠনগুলো মনে করে, নির্দিষ্ট ছয়টি বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্যই দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এই ছয় বার্থ অপারেটর, সংসদীয় কমিটি এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একধরনের আঁতাতের অভিযোগও তুলতে চান সংশ্লিষ্ট লোকজন। বলা হচ্ছে, বারবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও ‘তালগাছ আমার’ সিদ্ধান্তে অটল থাকার কারণেই সুরাহা হয়নি এ সংকটের।
বার্থ অপারেটর নিয়োগের জন্য প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করা হলে ২৩টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। পরের বার শর্ত কিছুটা শিথিল করা হলে দরপত্র দিয়েছিল ২৬টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আইনের ফাঁক বের করে তৃতীয়বার দরপত্র দেওয়ার জন্য বেশ কিছু কঠিন শর্ত আরোপ করা হলে মাত্র নয়টি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। এ ক্ষেত্রে যা ছিল প্রায় অনিবার্য, অর্থাৎ, সেই ছয় বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েছে।
এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই, যত তাড়াতাড়ি বেসরকারি বার্থ অপারেটর নিয়োগ করা হবে, তত দ্রুত বন্দরের অস্থিতিশীলতা কাটবে। ৩ অক্টোবর ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বার্থ অপারেটর নিয়োগ অনুমোদন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক অনুমোদন নিয়ে এর কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এই সপ্তাহ থেকে নিয়োগ পাওয়া ছয় বার্থ অপারেটর কোম্পানি বন্দরে কাজ শুরু করতে পারবে। এর ফলে ছয় বার্থ অপারেটর নিয়োগ নিয়ে যত অনিয়মের প্রশ্নই থাকুক, আপাতত বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্বস্তি নেমে আসবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে মন্দের ভালো হিসেবে এ ব্যবস্থাই মেনে নিতে হবে আমাদের।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এ সমাধান কতটা দীর্ঘস্থায়ী? মূলত বেসরকারি বার্থ অপারেটর নিয়োগের বিষয়টি চালু হয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। সন্দেহ নেই, তখন বন্দর পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছিল। তখন ডক শ্রমিক পরিচালনা বোর্ড বিলুপ্ত করা হয় এবং বার্থ অপারেটরদের সরাসরি শ্রমিক নিয়োগের সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু একটি অনির্বাচিত সরকার যেভাবে শ্রমিকদের স্বার্থ উপেক্ষা করতে পারে, তা একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার বন্দর শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। যাচাই-বাছাই করে শ্রমিক পুনর্বহাল, চিকিৎসা, আবাসন, চাকরির নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি আছে সেই চুক্তিতে। এখন বেসরকারি অপারেটরদের দায়িত্ব সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা। তবে ডক শ্রমিক পরিচালনা বোর্ড যেহেতু নেই, এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে দেখভালের জন্য একটি কমিটি করে দিতে পারে। সম্প্রতি ডক বন্দর শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন যাচাই-বাছাই করা শ্রমিকদের নিয়োগসহ কয়েকটি দাবিতে আবার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। শ্রমিকদের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষের খবরও পাওয়া গেছে। এসবই বন্দরের স্থিতিশীলতার জন্য অশনিসংকেত। আমরা আশা করব, এ ক্ষেত্রে সম্মিলিত উদ্যোগ ও শুভবুদ্ধির জয় হবে। ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে না গিয়ে দেনদরবারের পথে যাওয়ার পরামর্শ দিতে চাই শ্রমিকনেতাদের। সদ্যগঠিত বন্দর উপদেষ্টা পরিষদও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। মোট কথা, বন্দর ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি শ্রমিকদের কল্যাণের বিষয়টি যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি কারণে-অকারণে বন্দরকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের প্রবণতাও বন্ধ করতে হবে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে।
আরেকটি বিষয় ভেবে দেখতে বলি সংশ্লিষ্ট সবাইকে। বর্তমানে বেসরকারি বার্থ অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, শুধু চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানই যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ, বেসরকারি অফ-ডক কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অভিজ্ঞতা, এমনকি মংলা বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানও যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যে ছয়টি বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে তিন বছরের জন্য কাজ দেওয়া হয়েছে, মেয়াদ শেষে তারাই আবার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কারণ, অন্য অপারেটররা তো অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগই পেল না। তিন বছর পর এ ছয়টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে যেকোনো মূল্যের প্রস্তাব দিলে তা-ই মেনে নিতে বাধ্য হবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আমাদের ধারণা, সরকারি সংগ্রহবিধি (পিপিআর), স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্টস (এসটিডি) এবং বার্থ অপারেটরের সংজ্ঞা-সম্পর্কিত গেজেট—এ তিন সরকারি আইনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা না গেলে বন্দরের বার্থ পরিচালনা উল্লিখিত ছয়টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হবে। বিষয়টি আমলে নেওয়ার সময় এখনই।
বেসরকারি বার্থ অপারেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত। আগেই বলেছি, এ সিদ্ধান্ত বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক। এখন বন্দরের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার কাজটি করতে হবে দ্রুত। জেটিতে জাহাজের গড় অবস্থানের সময় কমিয়ে আনা, বিদেশি জাহাজমালিকেরা যাতে এ বন্দরকে নিরাপদ ভাবতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং দেশের আমদানি-রপ্তানিকারকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে সবার আগে।
চট্টগ্রাম বন্দরকে বৈদেশিক বাণিজ্যের গেটওয়ে বলছি আমরা। অথচ এ বন্দরের সম্ভাবনার মাত্র ৬০ শতাংশ ব্যবহূত হচ্ছে এখন। বাকি ৪০ শতাংশ ব্যবহারের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রশ্নে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও মতৈক্যের বিকল্প নেই। অদূর ভবিষ্যতে ট্রানজিট বাস্তবায়নের জন্যও এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন অপরিহার্য।
ট্রানজিট নিয়ে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন। গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে স্বাক্ষরিত যৌথ ইশতেহারে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। বর্তমান সরকার ট্রানজিটের পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে ব্যবসায়ীসহ প্রায় সব মহলেরই সমর্থন আছে বলে মনে হয়। ট্রানজিটের মাধ্যমে পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য, নেপাল, ভুটান ও চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের অবাধ যোগাযোগ হলে খুলে যাবে বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার। বিএনপি ও সমমনা কিছু রাজনৈতিক দল রাজনীতির খাতিরে বিরোধিতা করলেও এর প্রয়োজন ও গুরুত্ব যে তারাও উপলব্ধি করেছে, তার প্রমাণ তো আমরা আগেই পেয়েছি। ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে করা নৌ-ট্রানজিট প্রটোকল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে নবায়ন করা হয়েছে, পরবর্তীকালে বিএনপির খালেদা জিয়াও ওই চুক্তি নবায়ন করেন। ফলে ট্রানজিট নিয়ে বিএনপির আন্দোলনের চেষ্টা হালে পানি পাবে বলে মনে হয় না।
সব মিলিয়ে এ প্রাকৃতিক বন্দরটি এখনো অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনেক স্বপ্ন দেখাচ্ছে আমাদের। অনিয়ম, দুর্নীতি, সিদ্ধান্তহীনতা ও অদক্ষতার কারণে বারবার হোঁচট খায় সেই স্বপ্ন। আমাদের স্বপ্ন বাঁচবে বন্দর বাঁচলে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.