বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪২৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ, বীর প্রতীক দুঃসাহসী যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ছিল কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলায় (তখন থানা)। তাঁদের দলনেতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ। তাঁর দলে শামসুদ্দীন আহমেদসহ মাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা ক্ষুদ্র এক দল।


দলনেতা আফতাব খবর পেলেন, তাঁদের এলাকায় পাকিস্তানি সেনা এসেছে। পাকিস্তানি সেনা কতজন, তাদের শক্তি কী, তা তিনি জানেন না। তার পরও তিনি পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গেরিলা আক্রমণ করার দুঃসাহসী এক সিদ্ধান্ত নিলেন।
এরপর তাঁর নির্দেশে শামসুদ্দীন আহমেদসহ মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত তৈরি হলেন। তাঁদের কাছে অস্ত্র বলতে স্টেনগান, রাইফেল আর কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড। গুলিও সামান্য। তা-ই সম্বল করে তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে। তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হলেন শেরপুরে। দৌলতপুর উপজেলারই অন্তর্গত শেরপুর।
দলনেতার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ চালালেন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। আকস্মিক আক্রমণে সেনারা হকচকিত। তবে নিমিষেই তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। ব্যাপক সেই আক্রমণ। বৃষ্টির মতো শত শত গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার ওপর দিয়ে যেতে থাকল। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে মাথা তোলাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল।
পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিগুণেরও বেশি। তাদের অস্ত্রশস্ত্রও মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে অত্যাধুনিক। একপর্যায়ে পাকিস্তানি আক্রমণের তীব্রতা প্রচণ্ড বেড়ে গেল। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এর ফলে তাঁরা প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে পড়ে গেলেন।
এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা সিদ্ধান্ত নিলেন পশ্চাদপসরণের। তিনি শামসুদ্দীন আহমেদসহ অন্য সহযোদ্ধাদের দ্রুত পেছনে হটে নিরাপদ স্থানে যেতে বললেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ শুরু করলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ধাওয়া করল।
ছত্রভঙ্গ মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের পেছন পেছন পাকিস্তানি সেনারাও ব্যাপক গুলি করতে করতে যেতে থাকল। ব্যাপক গুলির মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল। তাঁরা কখনো ক্রল করে, কখনো দৌড়ে যেতে থাকলেন।
এভাবে শামসুদ্দীন আহমেদ ও তাঁর এক সঙ্গী ছাড়া সবাই পালাতে সক্ষম হলেন। তাঁরা দুজন বেশি দূর যেতে পারলেন না। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা শামসুদ্দীন আহমেদকে শেরপুরের পাশের সাতবাড়িয়া গ্রামে ঘেরাও করে।
ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত শামসুদ্দীন আহমেদ অস্ত্রসহ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তখন তাঁর কাছে কোনো গুলি ছিল না। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে আটকের পর সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বরের।
শামসুদ্দীন আহমেদ ১৯৭১ সালে কৃষিকাজের পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩২ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ শেষে ভারতে যান। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাব-সেক্টরে। কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তিনি সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩০১।
শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদের পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার মহিষখোলা গ্রামে। তিনি বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম হাউস সরদার, মা জরিমন নেছা। স্ত্রী আনোয়ারা খাতুন ওরফে আনারজান। তাঁদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে।
শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮ ও স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.