বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে-এ মৃত্যুর জবাব কী?

আমাদের দেশে মানুষের জীবন যে কত তুচ্ছ, কত হেলাফেলার বিষয়, রোববার রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজারের কাছে মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস তুরাগ নদে ডুবে যাওয়াই এর বড় প্রমাণ। বাসটিতে ৫০ জন যাত্রী ছিল বলে ধারণা করা হয়। কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠলেও বাকিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।


সাঁতরে তীরে উঠতে গিয়ে ডুবে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী মনোয়ারা খাতুন। এই মৃত্যুর জবাব কী? প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, চালক অন্য একটি বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বাসটি সেতুতে ওঠার মুহূর্তে দুর্ঘটনার শিকার হয়। একজন বাসচালকের খামখেয়ালির জন্য এতগুলো মানুষের প্রাণহানি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
যেসব কারণে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালনা তার একটি। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের আগে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল। এরশাদের আমলে সেই শাস্তি কমিয়ে তিন বছর করা হয়। তাও শাস্তি পাওয়ার ঘটনা বিরল। ফলে চালকদের মধ্যে বেপরোয়া ভাব লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ সড়ক অবকাঠামো, দুর্বল ট্রাফিক-ব্যবস্থা এবং যাত্রীদের অসচেতনতার কারণেও অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী পরিবহন, টায়ার, ব্যাটারিসহ নিম্নমানের সরঞ্জামাদির কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তাই সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে হলে এসব সমস্যার সমাধানও খুঁজে বের করা প্রয়োজন। দুর্ঘটনা রোধে চালকদের যেমন ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে, তেমনি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচলও বন্ধ করতে হবে। এর পাশাপাশি দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই।
রোববারের দুর্ঘটনাটির জন্য মূলত চালকই দায়ী। সড়কপথে এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কেবল বেআইনি নয়, ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী গুরুতর অপরাধও। দুর্ঘটনার এক দিন পরও বাসটি উদ্ধার না হওয়া আমাদের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ও অক্ষমতার দিকটিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আগেভাগে বাসটি উদ্ধার করা গেলে হয়তো আরও কিছু যাত্রীকে বাঁচানো যেত। সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি উদ্ধারকাজেও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
অতীতে দেখা গেছে, এ রকম ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কিছুদিন তোড়জোড় করেন, বাস জব্দ হয়, চালক আটক হন; কিন্তু দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এবারও তার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। কারণ যাই-ই হোক না কেন, দুর্ঘটনার নামে এভাবে মানুষ হত্যার ছাড়পত্র কাউকে দেওয়া যেতে পারে না। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি হলো, সেসব অপনোদনে টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
আমিনবাজারে বাস দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাই সমবেদনা ও সহমর্মিতা। আমরা তাঁদের ফিরিয়ে আনতে পারবে না সত্য; কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ বেঘোরে প্রাণ না হারান, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবহন মালিক, চালক, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার। ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য’ যে অনেক বেশি, সেটি কথায় নয়, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.