সরল গরল-উদ্ভট উটের পিঠে পঞ্চম সংশোধনী by মিজানুর রহমান খান

আজ গল্প বলব। আষাঢ়ে গল্প নয়। সংবিধান সংশোধনবিষয়ক গল্প। কয়েকজন সাংসদের কৃপা হলো। তাঁরা বিশেষ কমিটিতে বিলি করা কাগজপত্র আমাকে দেখালেন। আমার কাছে তা রূপকথার গল্প মনে হলো। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের রায় জানতাম। সেখানে অনেক কথা। বহু পর্যবেক্ষণ। কিন্তু যা রায় বা আইনে পরিণত হলো, তা লেখা হলো সংক্ষেপে।


সেটাই নিয়ম। একটি বা তিন বাক্যে সারকথা। কিন্তু হাইকোর্টের সারকথা এক রকম। আপিল বিভাগেরটা হলো আরেক রকম। আবার সেটা বাস্তবায়নে যে অনুশীলন, সেটা আবার ভীষণ অন্য রকম। একদম অচেনা মনে হলো। সে কথাই আজ পাঠকদের বলব।
তবে হ্যাঁ, হাইকোর্টের রায়ে কিছু অস্পষ্টতা ছিল। দুই রকমভাবে মনে করা চলে, এমন উপাদানও সেখানে ছিল ও আছে। আপিল বিভাগের রায়ের পরও তা পুরোপুরি দূর হয়নি; বরং কিছু অস্পষ্টতা আরও মাত্রা পেয়েছে। এমনকি বিভ্রান্তি বৃদ্ধি করেছে। তবে সার্বিকভাবে এই রায় যে মাইলফলক, একটা অনন্যসাধারণ অর্জন, তাতে সন্দেহ নেই।
হাইকোর্ট আমাদের কী দিলেন? তাঁরা বললেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, ৬, ৮, ৯, ১০, ১২, ২৫, ৩৮, ৯৫ ও ১৪২ অনুচ্ছেদ বাহাত্তরে ফিরে যাবে। এ ছাড়া বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শসংক্রান্ত আদি ৯৫(১) অনুচ্ছেদটিও ফিরে আসবে। আমাদের গণমাধ্যম সংক্ষেপে শিরোনাম করতে ওস্তাদ। কম কথায় শিরোনাম চাই। এটা করতে তাদের হাত সর্বদা নিশপিশ করে। তাদের এই স্বভাবের সঙ্গে রাজনীতিকদের মেঠো-বক্তৃতার বেশ মিল আছে। কোনো সাবধানতা নেই। উদাহরণ দিই। হাইকোর্ট সাধারণভাবে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ও বেআইনি বলেছেন। কিন্তু এটা তাঁর নিঃশর্ত রায় নয়। কারণ, বিসমিল্লাহসহ আরও অনেক অনুচ্ছেদ আনা হয়েছিল সামরিক ফরমান দিয়ে। সেগুলো হাইকোর্ট একমুখে বেআইনি বলেছেন। আবার অন্যমুখে এবং কার্যকর অর্থে সেগুলো মার্জনা করেছেন। এর মানে হলো, সেগুলোকে বৈধ বলে মেনে নিয়েছেন। শিরোনামের ধরন বলি। পঞ্চম সংশোধনীর কতিপয় অনুচ্ছেদ বাতিল। জিয়ার ক্ষমতা দখলকে অবৈধ বলেও তাঁর নির্বাহী কার্যাবলিকে মার্জনা। কিন্তু তা হয়নি। শুনেছি, বেগম খালেদা জিয়াকে বলা হয়েছিল, ম্যাডাম, সর্বনাশ ঘটে গেছে। আপনার সরকার পর্যন্ত অবৈধ হয়ে পড়েছে। সে কারণে গভীর রাতে কোর্ট বসল। আমরা ২০০৬ সালের দিনদুপুরে কী দেখলাম। অ্যাটর্নি জেনারেলকে দৌড়াতে দেখলাম। রায়ের খবর প্রকাশে পত্রিকাগুলোর বাড়াবাড়ি অনেকটা দায়ী। এ রকম না করলে বিএনপি ‘বিকৃত’ ব্যাখ্যা দিতে পারত না।
আপিল বিভাগে শুনানি চলছিল। তখনো মওদুদ আহমদরা বলছেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল। তার মানে বাকশাল ফিরে আসছে। আওয়ামী লীগ জোর গলায় এর প্রতিবাদ করেনি। তারা বলেনি যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়নি। তাহলে যে তাদের জোশ কমে। এরও একটা রাজনীতি আছে। সেটাই এ দেশের মূলধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এক টিভি আলোচনায় মওদুদ, তোফায়েল আহমেদ ও আমি উপস্থিত। উপস্থাপক আমাকে বললেন, মওদুদ বলছেন বাকশাল ফিরে আসবে। আপনি কী বলেন? আমার হাতে রায়ের কপি। কবির লড়াইয়ের মতো একটা অনুভূতি হলো। মওদুদ আহমদ কত বড় স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। তাঁকেই কিনা আমার মতো অভাজনের বাগে পাওয়া। বইটি দেখালাম। বলুন, রায়ের কোথায় লেখা আছে, বাকশাল আসবে। তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি!
আপিল বিভাগের রায় পড়লাম। বেশ অবাক হলাম। তাঁরাও অনেক কথা বলেছেন। অনেক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তাঁদের রায়েরও কার্যকর অংশ আছে। অবশ্যই সংক্ষেপে। এই মামলায় লিভ টু আপিলের আবেদন মঞ্জুর করেননি আপিল বিভাগ। পত্রপাঠ বিদায় করেছেন খোন্দকার দেলোয়ারদের। এর মানে হলো তাঁরা এমন উল্লেখযোগ্য কোনো কারণই খুঁজে পাননি; যাতে কিনা হাইকোর্টের রায়ের বড় কোনো পরিবর্তন আনা চলে। নিয়ম হলো, বড় পরিবর্তন ঘটাতে চাইলে পূর্ণ শুনানি হতে হবে। তর্কিত প্রশ্নে উভয় পক্ষের যুক্তি লেখা হবে। তার বিচারিক পর্যালোচনা থাকবে। অতঃপর কারণ দেখিয়ে আদালত তাঁর পাকা সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম তর্কিত প্রশ্ন চিহ্নিত হলো না। লিভ খারিজ হলো। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বড় পরিবর্তন দেখলাম। অনেকটা পিক অ্যান্ড চুজ।
এখন শঙ্কার কথা বলব। তবে এটা যেন সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়, কর্পূরের মতো উবে যায়, সেই আশা করব। হাইকোর্ট প্রস্তাবনাসহ ১০টি অনুচ্ছেদকে নির্দিষ্টভাবে মূল সংবিধানে ফেরাতে বলেছেন। আপিল বিভাগ দুটি অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের সঙ্গে একমত হননি। হাইকোর্ট বলেছিলেন, নাগরিকত্ব হবে বাঙালি। আপিল বিভাগ বলেছেন, এটা হবে বাংলাদেশি। আর ৯৫(১) ফেরাতে তাঁরা রাজি হননি। এ ছাড়া আরেকটি ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। সেটা টেকনিক্যাল ব্যাপার। হাইকোর্ট অত্যন্ত জোরালো যুক্তি দিয়েছিলেন যে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে (১৫০ অনুচ্ছেদ) ৩ক প্যারাগ্রাফ অবৈধ। এখানে বন্দুকের নলে সংবিধান সংশোধনের ভূতাপেক্ষ ও ভাবিসাপেক্ষ শ্রেষ্ঠত্ব বহাল আছে। তবে এও ঠিক, হাইকোর্টের রায়ে বিষয়টি নির্দিষ্ট হয়নি। তার মানে হাইকোর্ট এই অংশ বাতিল করে মূল সংবিধানেও যেতে বলেননি। আপিল বিভাগ করলেন কী, এ-সংক্রান্ত পুরো আলোচনাটাই হাইকোর্টের রায় থেকে মুছে ফেললেন।
আপিল বিভাগের রায় পড়ে খটকা জাগল। হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে। শুধু একআধটু মডিফিকেশনস বা সংশোধনী আসবে। তাহলে তাঁরা দশ-দফার বাইরে গেলেন কেন। আপিল বিভাগ বললেন, পঞ্চম সংশোধনীতে বাকশাল গেল। বহুদলীয় গণতন্ত্র এল। সেটা ভালো জিনিস। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও থাকবে। নোটিশ দিয়ে বিচারক বিদায় করার চেয়ে এটা উত্তম। আমি তখন মওদুদ এবং বিএনপির মেঠো-রাজনীতিকে কুর্নিশ জানালাম। ভাবলাম, এটা বুঝি একটা আপস। জয়, মওদুদের বাকবিলাসের জয়। টিভি তর্কে মওদুদই সদুত্তর দিয়েছিলেন। আমিই বোকার হদ্দ। যাক ভালোই তো। আপিল বিভাগের রায় বিএনপিরও পছন্দ হলো। তারা খুব একটা আহাজারি করল না। তাদের শহীদ জিয়া প্রশংসিত হয়েছেন। ব্যস, আর কী চাই। অথচ বলে রাখি, আপিল বিভাগের রায়ে এসবের কোনো মার্জনা দরকার ছিল না। কারণ, ওই ১০টি অনুচ্ছেদ হাইকোর্ট আগেই আলাদা করলেন। এগুলো বাদে সামরিক ফরমান দিয়ে করা অন্য সব পরিবর্তনকে তো হাইকোর্ট মার্জনা করলেন। বৈধভাবে টিকিয়ে রাখলেন। মার্জনা করা বিষয় সম্পর্কে আপিল বিভাগ হয়তো দু-চার কথা বলতে পারতেন। নতুন করে কোনো পর্যবেক্ষণ দিতে পারতেন। কিন্তু তা তাঁরা করলেন না। মূল রায়ের কার্যকর অংশে একেবারে ঘটা করে এক গন্ডা অনুচ্ছেদের [৪৪, ৯৬, ১০২(১), ১১৭ক] নাম নিলেন এবং তা মার্জনা করলেন। এহেন ডাবল মার্জনার কারণ কী? অথচ আমরা দেখি, ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবনে হাইকোর্টের রায় ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সেই ত্রুটি আপিল বিভাগও দূর করেননি।
আমরা সবাই রিট কথাটির সঙ্গে পরিচিত। কারও মৌলিক অধিকার খর্ব হলো। চলো, হাইকোর্টে ১০২(১) অনুচ্ছেদমতে রিট করি। বাহাত্তরের সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে (এখানে ১০২(১) এর উল্লেখ আছে) এই অধিকার দেওয়া হয়। বিতর্কিত চতুর্থ সংশোধনীতে তা কেড়ে নেওয়া হয়। হাইকোর্টে রিট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা? তাই পুরো ব্যবস্থাটাই তুলে দেওয়া হলো। চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হলো, মৌলিক অধিকার বলবৎকরণে হাইকোর্ট অচল থাকবে। প্রতিকার দেবে নতুন সাংবিধানিক আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন। আপিল বিভাগ বললেন, পঞ্চম সংশোধনী মূল ৪৪ অনুচ্ছেদটি ফেরত দিয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে সেনা ফরমান। তাই এটা মার্জনা করা হলো। নাগরিকের প্রার্থনায় হাইকোর্ট যে অধিকার বলে রুল জারি করেন, তার উৎস ১০২(১) অনুচ্ছেদ। সুতরাং ৪৪ ও ১০২(১) অনুচ্ছেদ অবিচ্ছেদ্য। মানিকজোড়। কারও মৌলিক অধিকার (সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত) ক্ষুণ্ন হলে হাইকোর্ট যে প্রতিকার দেন, সেটা তাঁর ডিসক্রেশনারি বা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা নয়, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে আদালতে গিয়ে প্রতিকার চাইতে হবে। ১০২(১)-এ সে কথাই বলা আছে। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীতে ১০২(১) অনুচ্ছেদ থেকে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন করার অধিকার হরণ করা হয়; যা সেনা ফরমান দিয়ে ১৯৭৭ সালে মূল সংবিধানের আদলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আপিল বিভাগ এটা মার্জনা করেছেন। ১১৭ক নামে নতুন অনুচ্ছেদ ছিল বাকশালসংক্রান্ত। সেটাও তাঁরা নির্দিষ্টভাবে মার্জনা করলেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রবর্তনকেও মার্জনা করলেন। এর মানে তাহলে কী দাঁড়াল? হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের কি সঠিক ব্যাখ্যা হলো? আপিল বিভাগ মার্জনা না করলে কি বাকশাল ফিরে আসত? আপিল বিভাগ কী বলতে চাইলেন? কী বার্তা দিলেন? বিচারক অপসারণে সেই নোটিশ প্রদানের কালাকানুন ফিরিয়ে এনেছিলেন হাইকোর্ট? সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বলবৎকরণে হাইকোর্টে রিট করা ও সে মতে প্রতিকার প্রদানে হাইকোর্টের এখতিয়ার বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক খর্ব করেছিলেন? তিনি এসব মার্জনা না করে দেশে আসলে বাকশালী শাসন কায়েম করেছিলেন? মওদুদ সাহেবরা কি তাহলে অভ্রান্ত ছিলেন?
পাঠক ধৈর্য ধরুন। আপনাদের জন্য আজ আরও বড় খবর আছে। এতক্ষণ ধরে যা বললাম তা গৌরচন্দ্রিকা। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় একাত্তর পৃষ্ঠাব্যাপী একটি তুলনামূলক খসড়া বিবরণী তৈরি করেছে। সেটা কমিটিতে বিলি করা হয়েছে। এটা পড়ে চোখ ছানাবড়া। এতে প্রায় ৩৪টি অনুচ্ছেদ নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বেআইনি হিসেবে চিহ্নিত করা অনুচ্ছেদের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ২০টির বেশি। এগুলো হচ্ছে, ৪২(৩), ৪৭, ৫৮, ৬৫, ৬৬, ৭৩ক, ৮০, ৯২ক, ৯৩(১), ৯৮, ৯৯, ১০১, ১০৩, ১০৭(১), ১১৬, ১১৭, ১২২, ১৪২, ১৪৫ক, ১৪৭(১), ১৪৮, ১৫২। ওই প্রতিবেদনে কমিটিকে ‘বিশদভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে ওই ২০টির মধ্যকার ১২টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
আইন কমিশনের সচিবের সই করা (৮ আগস্ট ২০১০) একটি পত্র দেখলাম। এতে লেখা, ‘কমিশন মনে করে প্রেরিত খসড়া বিবরণীর মন্তব্য কলামে বর্ণিত বক্তব্যসমূহ মোটামুটি সঠিক।’ খোঁজ নিয়ে জানলাম, তিন সদস্যের কমিশন কোনো বৈঠকে বসেনি। কমিশনকে প্রতিষ্ঠানগতভাবে বিশেষ কমিটিতে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এর চেয়ারম্যান কমিটির অতিথি সদস্য মাত্র। আমার মত হলো, আইন মন্ত্রণালয়ের খসড়াটি অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। কারণ, এতে ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা আছে। একটি দৃষ্টান্ত দিই। ওই বিবরণীর ৩৫ পৃষ্ঠায় ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলা আছে, এর সংশোধন হাইকোর্ট বেআইনি বলেছেন এবং আপিল বিভাগ তা অনুমোদন করেছেন। এটা একটা মারাত্মক অপব্যাখ্যা। আপিল বিভাগের রায়ে নির্দিষ্টভাবে ১১৬ অনুচ্ছেদ মূল সংবিধানে যেমন ছিল, তেমনটা ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা আছে। অথচ খসড়া বিবরণীতে প্রকারান্তরে মাসদার হোসেন মামলার রায় ধ্বংসের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা মানা হলে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিনাশে কি কোনো নিপুণ হাত সক্রিয় হয়ে উঠেছে? এই গুরুতর প্রশ্নটি করতাম না, যদি না তার কিছু আলামত প্রত্যক্ষ করতাম। আমি সংবিধান পুনর্মুদ্রণের একটা খসড়া দেখলাম। একেবারে কাঁচা নয়। আবার ভরসা করার মতো দলিলও পাইনি। সেখানে দেখি, সংবিধানের উল্লিখিত ৪৪ ও ১০২(১) অনুচ্ছেদকে পঞ্চম সংশোধনী-পূর্ববর্তী অর্থাৎ বাকশালী ধাঁচে পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মানে হলো, হাইকোর্ট যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে এত বড় রায় লিখলেন, সেই ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলা এবং তা অন্তত হাইকোর্টের রায়ের বরাত দিয়েই। সত্যি সেলুকাস! বিচিত্র এই দেশ!
কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা বললেন, এমন তো কিছু শুনিনি। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদকে বললাম, আপনার মন্ত্রণালয় এ রকম একটি খসড়া কী করে কমিটিতে দিল? ৪৪ ও ১০২(১) অনুচ্ছেদের সংশোধন প্রস্তাব রয়েছে এমন একটি অনুশীলনও নজরে এল। ৩ক বিলোপ করা হচ্ছে রায়ের বরাতে। এসব কিছু আমাদের উদ্বিগ্ন ও বিচলিত করছে। আইনমন্ত্রী এমনভাবে জবাব দিলেন, যা থেকে বোঝা যায় না আদৌ এ রকম কিছু ঘটছে কি না। সবটাই হয়তো আমাদের ভুল! আইনমন্ত্রী বারবার অবশ্য বললেন, ‘আমরা এখনো চূড়ান্ত কিছু করিনি।’ সেটাই সত্যি হোক। বিশেষ কমিটির কাছে রায়ের সঠিক ব্যাখ্যা অর্থাৎ ১০টি অনুচ্ছেদে সীমাবদ্ধ থাকার মতো প্রতিবেদনও দেখলাম। সেটাই সত্যি হোক। তবে সন্দেহ ঘোচে না।
অন্তত একজন সংসদ সদস্য বিভ্রান্ত (হয়তো পরে দেখব আমিই বিভ্রান্ত) হয়েছেন, তার প্রমাণ পাই। হাইকোর্ট বাদ দিয়ে তিনি যেন সাংবিধানিক আদালত চান। গত ২২ আগস্ট কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে তিনি লিখিত মতামত দেন। এতে ৪৪ ও ১০২(১) অনুচ্ছেদ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘এটা সংসদ ও হাইকোর্টের ক্ষমতা নির্ধারণসংক্রান্ত। হাইকোর্ট বাতিল করেছিলেন, আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। এটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।’ কী সাংঘাতিক অপব্যাখ্যা।
প্রধান বিচারপতি সংবিধান পুনর্মুদ্রণের কথা বলায় একটা নতুন বিতর্ক এসেছে। আমরা মনে করি যে রায় অনুযায়ী ওই দশটি অনুচ্ছেদ পরিবর্তিতরূপে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে। মুদ্রণ করা না-করার মধ্যে তফাত নেই। তবে আদালতের রায়ে একটা বাস্তব সাংঘর্ষিক অবস্থা (ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মীয় সংগঠনসংক্রান্ত) তৈরি হয়েছে। সেটা দূর না করলে স্বস্তি আসবে না। সংবিধান শুদ্ধ হবে না। সেই দায় সংসদের। কিন্তু এখন আমরা জোর গলায় দাবি করি যে রায় মানে কী, রায়ের দোহাই দিয়ে কোথায় কী পরিবর্তন আনা হবে, তা পুনর্মুদ্রণ কিংবা সংসদে বিল আনার আগে স্পষ্ট করা হোক। রিভিউ হতেও বাধা নেই। অজ্ঞতা, অসতর্কতা বা কূটকৌশল, কারণ যা-ই থাক, যা নয়, সেভাবে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ কিংবা সেভাবে গণ্য করা কাম্য নয়। ‘বাজিকররা’ যেন সংবিধান নিয়ে বাজি না ধরেন। পঞ্চম সংশোধনীর মূল রায় প্রণেতা এখন প্রধান বিচারপতি। তাঁর রায় বিকৃত করা হলে, ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা হলে তা শুধু বাড়তি জটিলতাই ডেকে আনবে। সরকার কিংবা সংসদ যদি পরিবর্তন আনে তবে তাকে সামনের দরজা দিয়ে তা করতে হবে। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে নয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.