বাবা দিবস by একরামুল হক শামীম

'কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/ আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়...।' হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া এই গানটি খুবই বিখ্যাত। যাদের বাবা বেঁচে নেই, এই গান তাদের নস্টালজিক করে দেয়।
মাঝেমধ্যে এমনও তো সময় হয়, যখন আর কিছুতেই মন বসে না। বন্ধুর সঙ্গে জমিয়ে টেলিফোন আলাপেও সায় দেয় না মন। টুপ টুপ বৃষ্টির শব্দ তখন হয়তো জানালার ওপাশে। গ্রিলটাতে মাথা রেখে পড়ন্ত বৃষ্টির ফোঁটার দিকে চেয়ে থাকা সন্তানের মনোজগতে একে একে হাজির হয় পুরনো স্মৃতি। তখন মনে হতেই পারে যে, বাবার মতো কেউ তাকে ডাকে না। কেউ বলে না জীবনের মধুর গল্পগুলো।
জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বের প্রায় ৭৪টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। তৃতীয় রোববার হিসেবে এ বছর ১৭ জুন পালিত হচ্ছে বাবা দিবস। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যই এই দিবস। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০৮ সালে প্রথম বাবা দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টে ৫ জুলাই এই দিবস পালন করা হয়। মিসেস গ্রেস গোল্ডেন ক্লেটনের উদ্যোগেই মা দিবসের আদলে দিবসটি পালিত হয়। ১৯০৭ সালের একটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ২১০ জন বাবার স্মৃতির উদ্যোগে সেবারের দিবস। তবে তা নিয়মিত হয়নি। তার দুই বছর পর ১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনোরা স্মার্ট ডট নতুন পরিসরে বাবা দিবস পালন করে। সেনোরাকেই বাবা দিবসের উদ্যোক্তা মনে করা হয়। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন জুন মাসের তৃতীয় রোববারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতি বছর জাতীয়ভাবে বাবা দিবস পালনের রীতি চালু করেন।
বাবা দিবসে সংবাদপত্রে, বল্গগে অনেক ধরনের স্মৃতিকাতর লেখা পড়ি। সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো ব্যবহারকারীরা এখন ফেসবুক, গুগল প্লাস টুইটারে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানায় বাবা দিবসে, বাবার স্মৃতিচারণ করে। সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুক গেল বছর বাবা দিবসে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য অন্য রকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রতিদিন বাবা ও সন্তানের স্মরণীয় ছবি প্রকাশ করেছিল সাইটটি। সঙ্গে ছিল ছবির পেছনের গল্প। বাবা দিবস এখন মোটামুটি ঘটা করেই পালিত হচ্ছে। তার পরও এমন ভাবনা অনেকের মধ্যেই দেখি যে, বাবার জন্য একদিন কেন! কেউ কেউ বলে থাকেন, বাবা দিবসটা ঠিক আমাদের জন্য নয়। বাবার জন্য আমাদের অনুভূতি প্রতিদিনকার। তার জন্য আলাদা দিনের দরকার নেই। কারও কারও অভিযোগ, এ ধরনের দিবসগুলো করপোরেট কিছু বিষয়কেই বিজ্ঞাপিত করে।
একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য দেওয়া যাক। ২০১০ সালের বাবা দিবসে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ৯৫ মিলিয়ন শুভেচ্ছা কার্ড পেয়েছিলেন বাবারা। বলা যেতেই পারে, এ কেবল কার্ড বিজনেস। সবকিছুর পরেও তো বাবা দিবসে প্রিয় সন্তানের কাছ থেকে বাবারা পেয়েছেন শুভেচ্ছা কার্ড। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বাবাটি দীর্ঘদিন পর দেখা পেয়েছেন প্রিয় সন্তানের।
প্রায় পাঁচ বছর আগে, ২০০৭ সালে বাবা দিবসের কয়েক দিন আগে গিয়েছিলাম গাজীপুরের একটি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেখানে সারাদিন কাটিয়ে এসে বুঝতে পেরেছিলাম নচিকেতার সেই গানের বাস্তবতা। 'ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি/ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।' সেই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে দেখেছিলাম এমন অনেক বাবাকে, যারা তাদের জীবনের সেরা সময়গুলো বিলিয়ে দিয়েছেন সন্তানের সুখের জন্য। এমন এক বাবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যিনি তার সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকায় কেনা ফ্ল্যাটটি প্রিয় সন্তানকে দিয়েছেন। অথচ শেষ বয়সে সেই বাবারই আশ্রয় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রম নয়, বাবার আশ্রয় প্রিয় সন্তানদের কাছেই থাকুক। বাবা দিবসে পৃথিবীর সব বাবাকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা।

No comments

Powered by Blogger.