মরুকরণ ও খরা প্রতিরোধ দিবস-করায়ত্ত জল, মরুপ্রবণ পৃথিবী by এম এম খালেকুজ্জামান

পানি বা জল—তৃষ্ণার্তের কাছে তার কোনো বিভেদ নেই। সুনামির ঢেউ হয়ে বারিরাশি কখনো প্রাণ-হন্তারক, ঝাঁপিয়ে পড়ছে লোকালয়ে। আগ্রাসী আকর্ষণে মুছে দিচ্ছে জীবনের রেখা। আবার এই জলরাশি কালে কালে গড়ে দিয়েছে সভ্যতা। প্রাচীনকাল থেকে পানির অবস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লোকবসতি।


পানির প্রয়োজনীয়তা বা অবদান অস্বীকার করতে পারেনি কোনো পরাক্রমই। তাই পানির অপর নাম জীবন কে না জানে!
‘পানির দামে বেচে দিলাম’, ‘পানির মতো সরল’ শব্দবন্ধ বা প্রত্যয়গুলো মোটেই দ্যোতনা সৃষ্টি করে না। কারণ, পানি যেখানে পেট্রলের স্থান নিয়েছে, সেখানে পানিকেন্দ্রিক জটিল ভূ-রাজনৈতিক কূটনীতি আন্তরাষ্ট্রিক সম্পর্কের যোগসূত্র হচ্ছে।
পানি এখন জটিল ভূ-রাজনৈতিক কূটনীতি ও আন্তরাষ্ট্রিক সম্পর্কের কেন্দ্রে এসে স্থান করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ এখন ভুগছে পানিস্বল্পতায়, ফলে তাদের বিদেশনীতি ও সমরনীতির পরিকল্পনায়ও এখন জায়গা করে নিয়েছে পানি। এখানে স্মরণ করা যায় Gurani Acquifer (গুরানি অ্যাকুয়াফেয়ার)-এর ঘটনার কথা। এটি ল্যাটিন আমেরিকার অন্যতম পানির উৎস, তার ওপর নজর পড়ে আমেরিকার। সাবেক বুশ প্রশাসনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এক গোপন সফরে যান ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে। গুরানি অ্যাকুয়াফেয়ারের বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে। এর কিছুদিন পরই জেনা বুশ, যিনি বুশ পরিবারের অন্যতম সদস্য, তিনিও ১০ দিনের গোপন সফরে প্যারাগুয়েতে গিয়ে তাঁর পরিবারের নামে ৯৮ হাজার ৮৪০ একর জমি কেনায় দূতিয়ালি করেন। যে জমি ওই জলাধারের খুব কাছে। ডোনাল্ড রামসফেল্ডের সফরের পরপরই আমেরিকা ৫০০ সেনার এক মিলিটারি বেজ স্থাপন করে এই জলাধারের তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে ইটাইপু ড্যাম, যা বিশ্বের অন্যতম বড় বাঁধ, তা এই জলাধারের খুব কাছে (ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে সীমানা এলাকায়) অবস্থিত। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বুশ পরিবার তাদের বহু পুরোনো পেট্রোলিয়াম ব্যবসা ছেড়ে পানির ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছে। পেট্রো-ডলারের বিপরীতে হাইড্রো-ডলারই সম্ভবত হতে যাচ্ছে আগামী বিশ্বের নিয়ন্তা।
ভারতের কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যে বিবাদের অন্যতম কারণ পানির হিস্যা নিয়ে বিরোধ। তামিল বীরাপ্পন কর্ণাটকি অভিনেতা রাজকুমারকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চেয়েছিল কাবেরী নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা। প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যায্য বণ্টনজনিত সংক্ষুব্ধতা থেকেই এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। যদিও ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন একে ধর্মীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব হিসেবে বিশ্বে উপস্থাপন করেছে বলে মনে করেন ভারতের মানবতাবাদী ও পরিবেশ আন্দোলনের নেত্রী বন্দনা শিবা। ভারত তার পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প এবং বড় বড় বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে।
গত শতকের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদকে কেন্দ্র। বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র তেল এখন দৃশ্যপট থেকে ঝাপসা হতে শুরু করেছে। তার পরিবর্তে তরল পানি দখল করেছে মূল মনোযোগ।
বৈজ্ঞানিক ও শিল্প-বিপ্লবের হাত ধরে সভ্যতা যত এগিয়েছে, পরিবেশ ও মানবজাতির মধ্যকার সম্পর্ক আরও বেশি রকমভাবে জটিল হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল ও বেহিসাবি ব্যবহারের বিপরীতে সম্পদের পুনরুৎপাদন-প্রক্রিয়া তত দ্রুত নয়। ফলে সাবেক শিল্পোন্নত এবং বিকাশমান শিল্পোন্নত দেশগুলোতে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা।
জাতিসংঘ এক হিসাবে বলছে, ১৫০ কোটিরও বেশি মানুষ পানির সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ১৯৯৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৮টি দেশ পানির সংকটে জর্জরিত, যা ২০২৫ সাল নাগাদ দ্বিগুণ হতে পারে। পানিসংকটের প্রেক্ষাপটে আগামী ২০৫০ সালে ৯৩০ কোটি জনসংখ্যার ৭০০ কোটিই ভুগবে পানিসংকটে। যথাযথ মানের পানির অভাবে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২৫ লাখ দূষিত পানিজনিত রোগে মারা যায়। এ কথা অনেকেরই জানা আছে যে পুরো পৃথিবীতে যে পরিমাণ পানি রয়েছে, তার মাত্র আড়াই শতাংশ পানি পানযোগ্য। সঙ্গে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই আড়াই শতাংশের দু-তৃতীয়াংশ বরফ জমাট অবস্থায় মেরু অঞ্চলে। বাকি এক-তৃতীয়াংশের ২০ শতাংশও খুব আয়াসসাধ্য সংগ্রহের অবস্থায় নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং অতি অবশ্যই খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও কৃষি উৎপাদন। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের ২০০০ সালের সমীক্ষামতে, ৭০ শতাংশ পানি কৃষির জন্য, ২০ শতাংশ শিল্প আর মাত্র ১০ শতাংশ গার্হস্থ্য প্রয়োজনে ব্যবহূত হয়।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে পানির সংকট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সংঘাতের মূল কারণ। কনভেনশন টু কনভার্ট ডিজার্টিফিকেশনের খতিয়ান অনুযায়ী, তীব্র খাদ্য চাহিদার বিপরীতে যথেচ্ছভাবে পানীয় জলের ব্যবহারের কারণে ইতিমধ্যেই চীনের ২৭ শতাংশ ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর দুই হাজার ৪৬০ বর্গমাইল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। প্রায় ৪০ কোটি জনসংখ্যা এই মরুপ্রবণ এলাকায় বাস করছে পানিস্বল্পতাকে নিয়তি মেনে।
বিংশ শতকের শেষ তিন দশকে যেমন জ্বালানি তেল ছিল রণকৗশলগত সম্পদ বা স্ট্র্যাটেজিক রিসোর্স একবিংশ শতকে এসে সে জায়গা নিয়েছে পানি। এই সম্পদ নিয়ে রাষ্ট্র রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে নানা বিতর্ক-বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে পানি ও পানীয় জলের চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে গিয়ে পৃথিবীকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মরুময়তার দিকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক দেশ ক্রমেই মরুকরণের গুরুতর পরিণাম সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে। বহু দেশ মরুকরণ প্রতিরোধ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণকে দেশের টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি নিজেদের বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী মরুকরণ প্রতিরোধসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করেছে।
এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
Khaliik@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.