আশুলিয়ায় সব পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা

অবশেষে আশুলিয়ার সব পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করল তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। আজ রোববার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে সংগঠন দুটির নেতারা জানিয়েছেন।


নেতারা বলছেন, ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং পোশাকশিল্পকে অস্থিতিশীল করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো আশ্বাসের ভিত্তিতে কারখানা খোলা সম্ভব হবে না।’ একই সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে প্রয়োজনে সারা দেশের পোশাকশিল্প বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেন তাঁরা। এ ছাড়া এখন শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দেন নেতারা। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) যৌথভাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন পোশাকশিল্পের মালিক নেতারা। বিজিএমইএর কার্যালয়ে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
এর আগে এক দিন বিরতি দিয়ে গতকাল রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়া ও কাঁচপুর শিল্প এলাকায় শ্রমিক-পুলিশ ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। কাঁচপুরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এ কারণে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিক ও শ্রমিক মিলে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের অন্তত ১১টি জায়গায় শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেন। সেখানেও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শতাধিক শ্রমিক আহত হন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা এ সড়কে অন্তত অর্ধশত যানবাহন ভাঙচুর করেন। দুই এলাকায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শত শত রাবারের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে।
এ ঘটনার পর রাতে সংবাদ সম্মেলন করে পোশাকশিল্পের মালিকেরা আশুলিয়ার কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন। বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম বলেন, ‘অপশক্তির ইন্ধনে ৩০ বছরে গড়ে ওঠা জাতীয় সম্পদ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। উদ্যোক্তারা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কারখানা খুলছেন এবং অনেকেই আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তি ও শিল্প উভয়ের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য আশুলিয়া এলাকার সব পোশাক কারখানা আমরা অত্যন্ত অপারগ হয়ে বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকদিন আগেই আমরা আলোচনায় বসেছিলাম। সেখানে আমাদের যা করনীয় আমরা সেই নির্দেশনা দিয়েছি। এখন হঠাৎ করে কেন মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দিলেন, কেন শ্রমিকদের সঙ্গে বসে তারা সমস্যার সমাধান করতে পারলেন না, কেন শ্রমিক-মালিকরা পরস্পরের কথা শোনেন না, পরস্পরের প্রতি আস্থা নেই সেটি তারাই জানেন’।
এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখি মালিকেরা কি বলে, শ্রমিকেরা কি প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা যদি আলোচনায় আসতে চায় আমরা সমঝোতার উদ্যোগ নিতে পারি। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে আমরা সেটি নিশ্চিত করবো। আমরা কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেবো না’।
সংবাদ সম্মেলন: বিজিএমইএর ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, পরিচালক আলমগীর কবির, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, পরিচালক আতিকুল ইসলাম, শহিদুল্লাহ আজিম, সিদ্দিকুর রহমান এবং আশুলিয়ায় আক্রান্ত পোশাক কারখানার কয়েকজন মালিক।
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে পোশাকশিল্পকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আমরা মনে করি, তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যায়ে চক্রান্ত শুরু হয়েছে। কারণ চক্রান্তকারীরা জানে, পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। কোনোভাবে এই শিল্পকে ধ্বংস করা গেলে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। এ দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।’
চক্রান্তকারী কারা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব গোয়েন্দা সংস্থার। তবে কিছু এনজিও এবং গার্ডিয়ান পত্রিকা মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করছে। এটাকে আমরা অপশক্তিই বলব।’
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, আশুলিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনে যুক্তিসংগত কারণ নেই। বলা হচ্ছে, মজুরি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকেরা কারখানা ভাঙচুর করছেন। কিন্তু গত ১৩ জুন শ্রমমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এত কোনো প্রকার দাবি-দাওয়ার বিষয় উঠে আসেনি। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শ্রমিকেরা যে মজুরি বাড়ানোর দাবি করবেন, তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ, মাত্র দেড় বছর আগে তাঁদের মজুরি গড়ে ৮০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সব কারখানায় এই মজুরিকাঠামো এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে।’
সভাপতি সফিউল ইসলাম বলেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আগামী ৭ জুলাইয়ের মধ্যে বেতন বাড়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু এটা সম্পূর্ণভাবে হা-মীম গ্রুপের বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের বিষয়। তারা নভেম্বর মাসের ইনক্রিমেন্ট এগিয়ে এনে জুলাইয়ে কার্যকর করবে। এটা মজুরি বৃদ্ধি নয়, একটি কারখানার বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট মাত্র। এর সঙ্গে সার্বিক পোশাক খাতের সম্পর্ক নেই।
বর্তমানে উচ্চ ব্যাংক সুদ, গ্যাস, বিদ্যুৎসংকট ও মন্দায় দিশেহারা পোশাকশিল্পের মালিকেরা ইতিমধ্যে কারখানা বন্ধ না করার শেষ চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেন সফিউল ইসলাম। এখন বেতন বৃদ্ধি করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন তিনি। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সভাপতি বলেন, বিশ্বমন্দার কারণে আমেরিকা ও ইউরোপে পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়া ছাড়াও দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ, মজুরি, ব্যাংক সুদ ইত্যাদি বাড়ায় অসহনীয় পরিবেশে আছেন উদ্যোক্তারা। সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য স্থির থাকলেও উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
আশুলিয়া ও কাঁচপুরে সংঘর্ষ: শ্রমিক অসন্তোষের কারণে গতকালও আশুলিয়া শিল্প এলাকার অধিকাংশ পোশাক কারখানায় ছুটি ছিল। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আশুলিয়া এলাকার কারখানায় গতকাল সকালে শ্রমিকেরা কর্মস্থলে এসে হাজিরা দেন। কিন্তু তাঁরা কাজে যোগ না দিয়ে কারখানায় অবস্থান নিলে কর্তৃপক্ষ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশঙ্কায় ছুটির ঘোষণা দেন। এরপর শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে জিরাব এলাকায় সংঘবদ্ধ হন। অন্যান্য কারখানার শ্রমিকেরাও তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সকাল সোয়া আটটার দিকে আশুলিয়ার ঘোষবাগ এলাকার অনন্ত গার্মেন্টের শ্রমিকেরা প্রথমে রাস্তায় নামেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন এনভয় গার্মেন্টের কর্মীরা। তাঁরা বাইপাইলের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ জামগড়ায় বাধা দেয়। শ্রমিকেরা রাস্তায় শুয়ে অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সকাল নয়টার দিকে পুলিশ নিশ্চিন্তপুর এলাকায় বাধা দেয়। রাবারের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে শ্রমিকেরা ইটপাটকেল মারেন। এ সময় মো. জাহিদ হাসান নামের একজন পুলিশ কনস্টেবল আহত হন। স্থানীয় একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রায় আধঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ চলার পর শ্রমিকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
সকাল ১০টার দিকে কয়েক হাজার শ্রমিক মিছিল নিয়ে নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কের বাইপাইল মোড়ে ওঠার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ বাধে। বাইপাইল থেকে পল্লী বিদ্যুৎ এলাকা পর্যন্ত নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কের দুই পাশের সব কারখানা ছুটি ঘোষণা করলে শ্রমিকেরা রাস্তা আটকে যানবাহন ভাঙচুর শুরু করেন। পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করলে শ্রমিকেরা ইটপাটকেল ছোড়েন। জবাবে পুলিশ রাবারের গুলি ছোড়ে। এ অবস্থায় শ্রমিকেরা পিছু হটে নবীনগরের দিকে চলে যান। প্রায় এক ঘণ্টা ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শ্রমিকদের একটি পক্ষ জামগড়া এলাকায় জড়ো হয়ে সড়কের ওপর গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। সেখানেও লাঠিপেটা ও রাবারের গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ।
দুপুরের দিকে আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একটি দলকে জামগড়া এলাকায় মহড়া দিতে দেখা যায়। আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আবদুল কাদের দেওয়ান বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের বোঝাতে চেষ্টা করছি, এভাবে পরিস্থিতি অশান্ত থাকলে আমাদের দেশের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাবে।’
কাঁচপুর শিল্পাঞ্চল: ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের শ্রমিকেরা সকাল নয়টায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পুলিশ তাঁদের রাস্তা থেকে সরাতে লাঠিপেটা করলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা ১০-১৫টি গাড়ি ভাঙচুর এবং রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেন। পুলিশের লাঠিপেটায় শ্রমিকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে কিছু সময় পর আবার জড়ো হলে দুই পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এলে শ্রমিকেরা কারখানার ভেতরে ঢুকে ফটক আটকে দেন। তাঁরা কারখানার ভেতরে আসবাব ও গাড়ি ভাঙচুর করেন। এরপর ভেতর থেকেই পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন তাঁরা।
সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন অর রশিদ জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সাত শতাধিক রাবারের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। শ্রমিকনেতা ইমরান হোসেন জানান, পুলিশের গুলি ও লাঠিপেটায় ৭০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন।
সংবাদ সংগ্রহে: অরূপ রায়, সাভার ও মনিরুজ্জামান, সোনারগাঁ

No comments

Powered by Blogger.