দাবার আনন্দ

কদিন আগেই বরিস গেলফান্ডকে হারিয়ে বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের শিরোপা ধরে রেখেছেন বিশ্বনাথন আনন্দ। দাবা নিয়ে তাঁর ভাবনা, জীবনদর্শন এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ভারতীয় সাময়িকী আউটলুকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটির চৌম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো


বিশ্বসেরা দাবাড়ুদের দৈব প্রতিভা, নাকি চর্চার ফসল?
বিশ্বনাথন আনন্দ  প্রতিভা এক জিনিস, তবে পরিবেশ, সঠিক মানসিকতা ও উৎসাহ—সবকিছু মিলিয়েই একজন চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু তৈরি হয়।
চর্চার দরকার কতটুকু? বড় কিছু পেতে হলে কতটা চেষ্টা বা বিনিয়োগের দরকার হয়?
 এখন প্রশিক্ষণের এত সুযোগ-সুবিধা আছে যে একজন শিশুর জন্য ঠিক কোন ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার, সেটাই আগে ঠিক করা যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে যেটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তা হলো, একেবারেই কম প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে করে সে খেলার আনন্দটা হারিয়ে না ফেলে। কোনো বিষয়ে সংশয় হলে তখনই কোচের শরণাপন্ন হওয়াটা জরুরি।
ভারত কি দাবায় সহজাত প্রতিভাদেরই পাচ্ছে?
 অনেকটা সে রকমই। সম্ভবত দাবাটা আমাদের রক্তেই আছে।
দাবার বোর্ডে আপনি দারুণ আগ্রাসী, বাস্তবে ঠিক তার উল্টো...
 দেখুন, দাবার বোর্ডে আগ্রাসী থাকাটা অনেক সময় বেশ কাজে দেয়। বোর্ডের বাইরে আমি আগ্রাসন প্রকাশ না করারই চেষ্টা করি। যাকে আমি সত্যিই হারাতে চেয়েছিলাম এমন কারও বিপক্ষে জয়টাকে আমি অবশ্যই ব্যক্তিগত পুরস্কার হিসেবেই দেখি। কিন্তু আমি মনে করি, আত্মবিশ্বাসী ও সুখী থাকাটাই আসল।
বড় কোনো টুর্নামেন্টের আগে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেন?
 শারীরিক ও মানসিক, দুভাবেই আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি। দৌড়ঝাঁপ, হাঁটাহাঁটি এসব করে আমি নিজেকে ফিট রাখার চেষ্টা করি। আর বড় কোনো টুর্নামেন্ট শুরুর বেশ কিছুদিন আগে থেকে আমি কিছু আইডিয়ার আগাপাছতলা ব্যবচ্ছেদ করতে থাকি। এর মানে এমন নয় যে অনেক অনেক ম্যাচ খেলতে হবে বা এমন কিছু। আমি আমার মতো করেই আমার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি।
দাবাড়ুদের জন্য শারীরিক অনুশীলনের গুরুত্ব কতখানি?
 আমি মনে করি, এটা যার যার খেলার ধরনের ওপর নির্ভর করে। দাবা খেলায় আসলেই অনেক মাথা ঘামাতে হয়, খাটনিটা তাই নেহাত কম নয়। কেউ কেউ নিজের মতো করে হাঁটাহাঁটি করে, আবার কেউ উত্তেজনাকেই উপভোগ করে।
কোন বিশেষ ধরনের মনঃসংযোগ বা ইয়োগা?
 আমার দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটার একটা অভ্যাস আছে। আমি লম্বা দম নিতেও পছন্দ করি, ম্যাচের আগে পাঁচটা লম্বা দম আমাকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
দশ বছর আগের সঙ্গে এখনকার আপনার পার্থক্য কোথায়?
 মানসিকতা তো খানিকটা বদলাবেই। আপনার জীবনে অবধারিতভাবেই এমন একটা সময় আসবে, যখন দাবাই আপনার ধ্যান-জ্ঞান, আপনার একটু বয়স হলে মনে হতে পারে জীবনে দাবাই সবকিছু নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খেলার প্রতি আপনার ভালোবাসাকে জিইয়ে রাখা।
আপনার দেহ-মনের ওপর দাবা কেমন প্রভাব ফেলে?
 টেনশন তো থাকবেই, কিন্তু আমার কাছে দাবা খেলা কখনোই তা নয়।
কখনো কোনো প্রতিপক্ষের কাছে নাকাল হয়েছেন?
 মাঝেমধ্যে কিছুটা খাবি তো সবাইকেই খেতে হয়। তবে আত্মবিশ্বাস ঠিক রাখাটাই সবচেয়ে বড় কথা।
হেরে গেলে নিজেকে কীভাবে সান্ত্বনা দেন?
 তখন তো ব্যাপারটা পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও থাকে না। কিছু বাইরের প্রভাবক তো আছেই, না চাইলেও যেগুলো আপনাকে প্রভাবিত করবে। আমি আমার মতো করেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।
কী খান? কোনো বিশেষ খাবার?
 সে রকম কিছু আসলে নেই। সারা বিশ্বে অনেক জায়গাতেই আমাকে যেতে হয়, আমি শুধু একটু বুঝেশুনে খাওয়ার চেষ্টা করি। নিত্যনতুন খাবার চেখে দেখতেও ভালোবাসি। তবে ম্যাচের আগে আমি কখনোই খাই না, তখন আবার আমার ঘুমে চোখ বুজে আসতে থাকে কিনা!
সামুদ্রিক খাবার তো মস্তিষ্কের জন্য বেশ উপকারী, মাছ খান তো?
 তা খাই। সারা বিশ্ব ঘুরে আমাকে খেলতে হয়, তাই এ অভ্যাসটা আছে।
অবসর কাটান কীভাবে?
 জ্যোতির্বিদ্যা আমার প্রিয় বিষয়। আমার স্ত্রী অরুণা ঘুরতে বড় ভালোবাসে। সুযোগ পেলে নতুন জায়গায় ঘুরি। বন্য প্রাণী নিয়েও আমাদের আগ্রহ আছে।
গান শোনেন, ছবি দেখেন?
 ইউটু বা কুইনের মতো রক ব্যান্ডের গান ভালোবাসি। সঙ্গীতেরও খোঁজ খবর রাখি। ছবিও দেখি, কদিন আগে স্ত্রীর সঙ্গে হ্যাংওভার ছবিটা দেখলাম।
দাবা পারিবারিক জীবনে কেমন প্রভাব ফেলে?
 যে পেশাতেই যাই না কেন, কিছুটা আত্মত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। খেলার কারণে মাঝেমধ্যেই বাইরে থাকতে হয়, তাই যখনই বাসায় থাকি পরিবারকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করি।
ছেলেকেও দাবাড়ু বানাতে চান?
 দাবা খেলাটা তাকে আমি শেখাব। খেলবে কি খেলবে না, সেটা ওর ব্যাপার।
আউটলুক থেকে ভাষান্তর: মোসতাকিম হোসেন

No comments

Powered by Blogger.