নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া কি জেলা পর্যায়ে বাজেট প্রণয়ন সম্ভব? by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

আজকের মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে বাজেট সম্পর্কে সাধারণভাবে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। ৭ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে মহাজোট সরকারের চতুর্থ বাজেট উপস্থাপন করেন। এটি বর্তমান সরকারের পূর্ণ বছরের শেষ বাজেট।


কেননা এর পরের বছর যখন বাজেট উপস্থাপন করা হবে, তখন সরকারের আর কয়েক মাস মেয়াদ থাকবে।
২০১২-১৩ অর্থবছরে বাজেটের মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.০ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। একে উচ্চাভিলাষী বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে এই বৃহৎ বাজেট তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য নির্বাচনের আগে সব গণতান্ত্রিক দেশেই সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু থেকে ফায়দা লোটার চেষ্টা করে থাকে। আবার একইভাবে বিরোধী দল সরকারের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে। অতএব, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আসলে কি বাজেটের আকার বেশি বড়? আমরা এ সরকারের পূর্ববর্তী বাজেট পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। ২০০৯-১০ সালের বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল এক লাখ এক হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। পরবর্তী বছর এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩০ হাজার ১১ কোটি টাকা। ২০১১-১২ সালে এই ব্যয়ের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা, যে বছরের পরিসমাপ্তি ঘটবে ৩০ জুন ২০১২।
আগামী বছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব্যয় বৃদ্ধির অনুপাত ঠিক রয়েছে। চলতি বছর এবং আগামী বাজেটে জিডিপির সঙ্গে ঘাটতির হার একই, অর্থাৎ ৫ শতাংশ। বিকাশশীল অর্থনীতিতে এই হারটা উদ্বেগজনক নয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে আগামী বছরের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে বাজেট প্রস্তাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য ৪৬ হাজার কোটি টাকার কথা বলা হয়েছিল। পরে সংশোধিত বাজেটে তা দাঁড়ায় ৪১.০৮ কোটি টাকায়। ২০০৯-১০-এ এর পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা এবং ২০১০-১১ সালে ৩৩ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। অতএব, এখানেও দেখা যাচ্ছে, বৃদ্ধির একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন সরকারের একনিষ্ঠতা, তৎপরতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে। সামনে নির্বাচন- এ কথা স্মরণ রেখেই সরকার তৎপর হবে। তা না হলে ভোটাররা তার মূল্যায়ন করবে। অর্থমন্ত্রী ৭ জুন তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, তাঁরা একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন রূপকল্প ২০২১। ইতিমধ্যে রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১) এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫)। বিগত তিনটি বাজেটই প্রণীত হয়েছে এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। অবশ্য বাজেটগুলো পর্যালোচনা করলে অর্থমন্ত্রীর এই কথার মর্ম উপলব্ধি করা যাবে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি জনগণকে আর্থিক অগ্রগতির চেয়ে নিজেদের জীবন সম্পর্কে বেশি চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তার ওপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গৎবাঁধা কিছু কথা এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাংবাদিকদের দূরে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার পরামর্শ মানুষকে হতাশ করেছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাবার কোলে শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ায় এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীর 'আল্লার মাল আল্লা নিয়েছেন' বলে যে মন্তব্য, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর যে কথাবার্তা, তা প্রায় একই পর্যায়ে পড়ে। যা হোক, এখনো সময় আছে, বহুল আলোচিত ও সাড়া জাগানো মামলা এবং গুম হওয়া বন্ধ করার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি, কথার ফুলঝুরি ছাড়া। নির্বাচনের কথা ভেবেই সরকারের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। মানুষের মাথা থেকে এই দুশ্চিন্তা নেমে গেলে তারা যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে চাইবে যে সরকার অর্থনৈতিক অগ্রগতির চেষ্টা চালিয়েছে। আগামী বছরও কৃষি খাতের উন্নতির জন্য ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির ব্যবস্থা রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন বেশ বেড়েছে; সেই সঙ্গে অবশ্য চাহিদাও। ঢাকা শহরের যেকোনো মধ্যবিত্তের ঘরে এসি রয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা বেশি হারেই বাড়বে- সরকারকে এ কথাটা মাথায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে।
এখন আসি আজকের লেখার শিরোনামে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম দিন থেকেই জেলা পর্যায়ে বাজেট প্রণয়নের সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। এ ছাড়া তিনি আরো কয়েকটি কথা বিভিন্ন সময়ে বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন। যেমন- তিনি কৃচ্ছ্রসাধন ও বেল্ট টাইটের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। কেননা তিনি একা চাইলে তো হবে না। একটি সরকারি সংস্থা দুজন কর্মকর্তার জন্য তিন কোটি টাকা দিয়ে দুটি গাড়ি কিনেছিল। এই দপ্তরটি তো একটি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত এবং সেই মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রী আছেন। তিনি এত বড় একটি অপচয় তথা অপকর্মের কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানা যায়নি। একটি বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন যে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড়ের পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে। সম্ভবত চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় এ কথা বলা হয়েছে, যা তিনি জুন ২০১১-তে বলেছিলেন। ঠিক তার কয়েক মাস পর যখন কয়েকটি মহাসড়কের অবস্থা খুব করুণ হলো, তখন সময়মতো টাকা পাওয়া যায়নি বলে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রকাশ্যে বললেন এবং স্পষ্টত অভিযোগের আঙুলটা অর্থমন্ত্রীর দিকে।
জেলা বাজেট সম্পর্কে ৭ জুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, তা অবিকল তুলে ধরা হলো- 'আমি গত বাজেট বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে বিদ্যমান বাজেট শ্রেণীবিন্যাস কাঠামো সংশোধনের কথা বলেছিলাম। ইতিমধ্যে আমরা একটি খসড়া শ্রেণীবিন্যাস কাঠামো প্রস্তুত করেছি। এটি বর্তমানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি, আগামী অর্থবছরের মধ্যেই এ কাঠামোটি আমরা চূড়ান্ত করতে পারব। এই কাঠামোটি চূড়ান্ত হলেই জেলা বাজেট প্রণয়নের যে অঙ্গীকার আমরা করেছিলাম, তা বাস্তবায়নের পথে বিদ্যমান কারিগরি বাধাসমূহ দূর হয়ে যাবে।'
এখানে লক্ষণীয় যে অর্থমন্ত্রী কারিগরি বাধাগুলো দূর হয়ে যাবে বলেছেন; কিন্তু আসল বাধা রাজনৈতিক, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। আর তা বলার সময় নেই। আওয়ামী লীগ দুই দফা ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য কিছুই করেনি। অবশ্য আইন পাস হয়েছে, কিন্তু কার্যকর করা না হলে কী লাভ এই আইন প্রণয়ন করে। ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় আসতে না পারলে নতুন যারা আসবে, তারা জেলা বাজেট ব্যবস্থাকে শিকেয় উঠিয়ে রাখবে। এটাই আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য। পূর্বসূরি যেটাই করে যাবে, তা পরিহার করতে হবে। যেমন- ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে উপজেলা পরিষদ বাতিল করে দেয় এটা এরশাদ চালু করেছেন বলে। জেলা প্রশাসনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট- কি আওয়ামী লীগ কি বিএনপি বা জাতীয় পার্টি- সবাই-ই আমলার মাধ্যমে জেলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। যে কারণে জেলা পরিষদ চালু হলো না আজও। অথচ ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হিসেবে জেলা বোর্ড চালু ছিল। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানও জেলা কাউন্সিল প্রবর্তন করেছিলেন। অবশ্য আমলাপ্রিয় ও আমলানির্ভর আইয়ুবের ব্যবস্থা সংগত কারণে আমলা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবু একটা কিছু ছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলায় জেলা পর্যায়ে কোনো জনপ্রতিনিধির ব্যবস্থা হলো না। বঙ্গবন্ধু যে বাকশালব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন, সেখানে কিন্তু জেলা পর্যায়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাকশাল পদ্ধতি চালু করার জন্য সব মহকুমাকে জেলা ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল এবং এর শাসকের নাম গভর্নর। এর দ্বারা বোঝা যায়, জেলাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন, উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতা এবং সংসদ সদস্যের অবস্থান নিয়ে নানা দ্বন্দ্ব আমরা দেখছি। আসলে এ ব্যাপারে মরহুম অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ সুন্দর বক্তব্য রেখেছিলেন এবং সেটি মনে হয় আসল কথা- ক্ষমতা থানা পরিষদের, তা সেটা উপজেলা হোক বা জেলা। ব্যক্তির ক্ষমতার প্রশ্নই আসে না। আমরা জানি না, অর্থমন্ত্রী যে উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা চালিয়ে জেলা বাজেট প্রবর্তনের কাজ সম্পন্ন করেছেন, সেটার কপালে কী আছে।
আমাদের প্রত্যাশা, যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখবে। জেলা পর্যায় থেকে বাজেট তৈরি হওয়া মানে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি প্রকল্প আসা।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.