কোচিং সেন্টার-নম্বর বনাম মূল্যবোধের লড়াই by শেখ শাহবাজ রিয়াদ

বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্য যাচাইকে আরও কার্যকর করতে পারলে শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টার থেকে দূরে রাখার পথ উন্মুক্ত হবে বলে আশা করা যায়। শিক্ষার্থীদের নম্বরমুখিতা থেকে মূল্যবোধমুখী, শিক্ষকদের কোচিংমুখিতা থেকে বিদ্যালয়মুখী করা এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।


প্রচলিত মূল্যায়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিমার্জনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়াতে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে


কোচিংকে অনেকেই শিক্ষা বাণিজ্য বা কোচিং ব্যবসা বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। আমরা এটিকে কোচিং আসক্তি, কোচিং সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করে থাকি। আবার একটি বড় গোষ্ঠীর কাছে কোচিং আভিজাত্যেরও প্রতীক। সাধারণত বিদ্যালয়গুলোতে কোচিং নিরাময়মূলক ব্যবস্থা হিসেবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য করা হতো, যাতে প্রধানত পাসের হার বৃদ্ধি পাওয়ার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কোচিংকে এক শ্রেণীর শিক্ষক রমরমা ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত করেছেন। কোনো একটি বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থী যখন বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট সময়ের পরে অথবা বিদ্যালয়ের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোনো একজন শিক্ষক বা একদল শিক্ষকের কাছে স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে অধিক নম্বর পাওয়ার কৌশল জানার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয় তাকে কোনোভাবেই শিক্ষা বলা যায় না । এটিকে শিক্ষার নামে বাণিজ্য বলাই যুক্তিযুক্ত। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো দেশের সেরা স্কুলের সেরা শিক্ষার্থীরাও কোচিংয়ে আসক্ত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপে গত ১ জানুয়ারি থেকে বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হলেও কোচিং সেন্টারের ক্লাস শুরু হয় তারও আগে। এমন কোনো বিষয় নেই যা কোচিং সেন্টারে পড়ানো হয় না। উদ্দেশ্য বেশি নম্বর পাওয়ার কৌশল রপ্তকরণ ও অনুশীলন। শিক্ষার্থীর যুক্তি হচ্ছে_ সবাই পড়ছে, সে না পড়লে ভালো করতে পারবে না। তা ছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। অভিভাবকের যুক্তি হচ্ছে_ তিনি তার ছেলেমেয়েদের ভালো রেজাল্টের ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তাছাড়া অধিক সচ্ছল অভিভাবকের কাছে ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়ানোটা তাদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক প্রতিপত্তির সঙ্গেও সম্পর্কিত। কোনো কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে অনেক অভিভাবক স্বস্তিবোধ করেন। কারণ তার সন্তান শান্তিমতো কোচিং করতে পারবে সেদিন। কোচিং শিক্ষার্থীদের কী দেয়? কোচিং শুধু শিক্ষার্থীদের আত্মকেন্দ্রিক, পরনির্ভরশীল ও নম্বরমুখী হতেই শেখায়। কোনো মূল্যবোধ, আদর্শ শেখায় না।
এমতাবস্থায় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে রাজধানীর ৪২টি স্কুল-কলেজের প্রধানদের সভায় কোচিং বন্ধের যে দাবি তাদের কাছ থেকে এসেছে তা খুবই ইতিবাচক মনোভাবের পরিচায়ক। কোচিং বন্ধের সিদ্ধান্ত আইন করে বাস্তবায়ন করা কঠিন। এর জন্য নিজ নিজ বিদ্যালয় থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে। শিক্ষকরা কোচিং না করানোর সিদ্ধান্ত একত্রে ঘোষণা করতে পারেন। তবে কোচিংয়ের প্রসার এত ব্যাপকভাবে কেন ছড়িয়ে পড়ল তার ওপর গবেষণা করে প্রকৃত কারণগুলো উদ্ঘাটন করাও জরুরি। অনেক শিক্ষক অবশ্য স্বল্প বেতনকে কোচিং করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন। শিক্ষকদের বড় একটি অংশ অভিভাবকদেরও দায়ী করেন কোচিংয়ের জন্য। প্রভাব ও প্রতিপত্তিশীল অভিভাবকদের একটি বড় অংশ অনেক শিক্ষককে কোচিং করাতে প্ররোচিত করেন; এমনকি অনেক সময় বাধ্যও করেন বলে তাদের অভিযোগ। এটি গেল বিদ্যালয় শিক্ষকদের কোচিং। এছাড়া কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক নন এমন এক শ্রেণীর 'ভাইয়া' কোচিং ব্যবসায় নিয়োজিত। তাদের কাছে কোচিং সম্পূর্ণভা্বইে জীবিকার মাধ্যম।
গত এক দশকে শিক্ষার মান উন্নয়ন, বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের যে গতিধারা চলমান তাতে গুণগত মানের প্রশ্নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও তার পরিমাণগত উন্নয়ন গতিধারা যে স্পষ্টতই সন্তোষজনক তাতে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। প্রতি বছর পাসের শতকরা হারের বৃদ্ধি, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যার বিস্ময়কর উত্থান, শূন্য ভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার পরিমাণ ক্রমাগত কমে যাওয়া, শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, নকল ও অন্যান্য কারণে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংখ্যা কমে আসা_ সবই মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন ধারার গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু শুধু পরীক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধি ও জিপিএর সর্বোচ্চ হারের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় ও সর্বোচ্চ ফলাফলকে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের মানদণ্ড করার কারণে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবাই কোচিংয়ের প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহিত হচ্ছে। ফলস্বরূপ অধিক নম্বর নিশ্চিতকারী বা নম্বরবর্ধক কোচিং ব্যবসা দিন দিন রমরমা রূপ ধারণ করছে। অন্যদিকে শিক্ষার যে প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবন যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি বিকাশ ও উন্নয়ন সেগুলো অর্জনের সম্ভাবনা কোনোভাবেই নিশ্চিত হচ্ছে না।
এ ক্ষেত্রে আমাদের মূল্যায়ন ব্যবস্থার আরও অধিক সংস্কার ও পরিমার্জন জরুরি। শিক্ষার্থীরা কী এবং কতটুকু জানে (তথ্য, তত্ত্ব, জ্ঞান) তাই শুধু আমাদের বর্তমান মূল্যায়ন ব্যবস্থায় জানা যায়। অর্জিত জ্ঞানকে তারা মননে, বিশ্বাসে ধারণ ও লালন করে কি-না, করলে কতটুকু কিংবা সে জ্ঞান ও মূল্যবোধ শিক্ষার্থীরা অনুশীলন করে কি-না সে দিকগুলো আমাদের প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্য যাচাইকে আরও কার্যকর করতে পারলে শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টার থেকে দূরে রাখার পথ উন্মুক্ত হবে বলে আশা করা যায়। শিক্ষার্থীদের নম্বরমুখিতা থেকে মূল্যবোধমুখী, শিক্ষকদের কোচিংমুখিতা থেকে বিদ্যালয়মুখী করা এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। প্রচলিত মূল্যায়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিমার্জনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়াতে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে। লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি থেকে, যারা শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নিতে চান তাদের চিহ্নিত করে নিয়োগ দিতে হবে। এরই সঙ্গে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা, পদোন্নতি এবং তাদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্তরভিত্তিক স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ ব্যক্ত করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের আশু উদ্যোগ নিতে হবে।

শেখ শাহবাজ রিয়াদ : সহকারী অধ্যাপক, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা
riadisrat1971@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.