অপমৃত্যু-কেন কাঁদি আমি! by আসিফ নজরুল

আমি বারবার বলি, শিওর আপনি! শিওর? নারী সাংবাদিক, হাতে ধরা মাইক্রোফোন, করুণ কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ! পাশ থেকে আরেকজন বলেন: দুজনই মারা গেছেন, মোট পাঁচজন। তারেক ভাই, মিশুক ভাই স্পটডেড! প্রেসক্লাবের সভা থেকে বের হয়েছিলাম খোলা বাতাসের জন্য।


খোলা বাতাস কি আর আছে কোথাও? আমি বরং প্রাচীকে (রোকেয়া প্রাচী) ফোন করে বলি সব। কান্নায় ভেঙেচুরে যায় ওর কণ্ঠ।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামি। মূসা ভাই (এবিএম মূসা) প্রেসক্লাবের ক্যানটিনে অপেক্ষা করছেন, তাঁর টেবিলে বসা মঞ্জু ভাই (মোজাম্মেল হোসেন)। খবর শুনে তিনি হতবাক, আর্তনাদ করে ওঠেন। মূসা ভাই নিষ্প্রাণ চোখে কী যেন খোঁজেন। ভাঙা কণ্ঠে তারেক মাসুদের নাম উচ্চারণ করেন কয়েকবার!
প্রেসক্লাবের ক্যানটিন অর্থহীন হয়ে পড়ে। ক্যানটিনের জানালার ওপাশে জীবনের স্পন্দন। ভেজা পাতার দোল, গাড়ির গতি, মানুষের অবিরাম নড়েচড়ে ওঠা! এই জীবনে, এই রোদ আর আলোয় তারেক মাসুদ নেই আর!
আমার চোখ দিয়ে হঠাৎ গলগল করে নোনা জল নামে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না, কেউ আমাকে একটু থামায়ও না। আমিই থামাই নিজেকে। কাঁদি কেন আমি? কেন কাঁদি? তারেক মাসুদ তো তেমন ঘনিষ্ঠ ছিলেন না আমার। দু-একবার ছাড়া ভালো করে কথাও হয়নি তাঁর সঙ্গে। কেন কাঁদলাম তাহলে আমি?

২.
বাসায় ফিরে টিভি দেখি। মানিকগঞ্জের দুর্ঘটনার খবর। মুষলধারে বৃষ্টিতে রাস্তার এক পাশে সারি করে রাখা পাঁচটি লাশ। তাঁদের একজন তারেক মাসুদ। তাঁর খালি শরীর, ভাঙাচোরা মুখ, বাঁকানো পা! এ-ই এখন তারেক মাসুদ? উদাত্ত শরীরের প্রাণখোলা হাসির সেই রাজকীয় মানুষ!
হায় রে আমার দেশ! এই দেশ বলেই তারেক মাসুদদের মৃত্যু সম্ভব এভাবে! মাথায় একসময় কিলবিল করে ওঠে ক্রোধ। নৌপরিবহনমন্ত্রী সুপারিশ করেছেন বিনা পরীক্ষায় ২৪ হাজার শ্রমিককে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য! ২৪ হাজার খুনি রাজপথে তিনি ছাড়তে চাচ্ছেন আমাদের জীবন সংহারের জন্য! ইতিমধ্যে ১০ হাজার এভাবে লাইসেন্স পেয়েছে তাঁর সুপারিশে। তাদের কেউ কেউ হয়তো এরই মধ্যে রাজপথ রঞ্জিত করেছে আমাদের রক্তে!
আর আছেন আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী! মহাসড়কের গর্তে উল্টে পড়ছে বাস-ট্রাক। চার ঘণ্টার রাস্তা হয়েছে ১২ ঘণ্টার। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হচ্ছে কোনো কোনো জেলার। নতুন সড়ক নেই, কোনো মেরামতও নেই, আরিচার মতো বহু বাঁকও সোজা হয় না কোনো দিন। তবু নির্লজ্জের মতো নিজের সাফাই গেয়েই চলেছেন তিনি।
আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী বা যোগাযোগমন্ত্রী কি কোনো দিন সড়ক দুর্ঘটনায় পড়বেন? আমার তা মনে হয় না। তাঁদের কয়েক কোটি টাকার গাড়িতে যান্ত্রিক ত্রুটি হবে না, তাঁদের বাড়ি যাওয়ার পথে কোনো খানাখন্দ বা বিপজ্জনক বাঁক থাকবে না, তাঁদের ড্রাইভারও বিনা পরীক্ষায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত কেউ হবে না। বাকি থাকে বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া যান। এই যান চলতেই দেওয়া হয় না এই মহামান্যদের যাত্রাপথে!
কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না আমাদের মন্ত্রীদের জীবনে তাই! দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাবে শুধু মিরসরাইয়ের স্কুলের একদল কিশোর, ফেরার পথে বাবা, ভূমিষ্ঠ সন্তানের মা। প্রাণ হারাবেন তারেক মাসুদের মতো একজন মানুষ।

৩.
কিন্তু আমরা কীভাবে মেনে নিই তাঁর মৃত্যু? তিনি আমাদের সংবিৎ ফিরিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের কাছে আমাদের নিয়ে গেছেন শুধু ছবি আর গানের মাধ্যমে। মুক্তির গান আর মুক্তির কথা বাংলাদেশকে চিরঋণী করেছে তাঁর কাছে। তাঁর মাটির ময়না বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে নতুন সম্মান আর সম্ভাবনার দিকে।
এমন একজন মানুষ ক্ষতবিক্ষত শরীরে ভূপাতিত হয়েছেন বর্ষণমুখর এক দুপুরে। নিশ্চয়ই তিনি বর্ষা, গ্রাম আর মাটিকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই অর্থহীন কোনো মৃত্যুতে ভূপাতিত হতে চাননি। তিনি বরং জীবনকে সবচেয়ে অর্থময় করার জন্য সর্বক্ষণ কাজ করেছেন। যত দিন তিনি কিংবা মিশুক মুনীরের মতো মানুষেরা বেঁচে থাকতেন, ততই শুধু দুই হাত ভরে দিয়ে যেতেন আমাদের।
আমি কাঁদি। কারণ এই মানুষেরা চলে যায় এভাবে! থাকে শুধু দেশ লুণ্ঠনকারী আর ভক্ষণকারীরা!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.