চিকিৎসা-ব্যবস্থা-চিকিৎসকেরা ভুল করেন না, অবহেলা তো নয়ই! by মশিউল আলম

বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে ভুল চিকিৎসায় ও চিকিৎসকদের অবহেলায় প্রতিবছর কত মানুষের মৃত্যু হয়? অঙ্গহানি ঘটে কতজনের? এ রকম জিজ্ঞাসার উদয় হতে পারে তাঁদের কারও কারও মনে, যাঁদের কোনো স্বজন এভাবে মারা যায়। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। কারণ, এই দেশে এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই।


চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠানগুলো বা চিকিৎসকেরা কেউই স্বীকার করেন না যে তাঁদের ভুল হয়, কর্তব্যপালনে অবহেলা ঘটে এবং তার ফলে রোগী মারা যায়। স্বীকার না করলে এ সম্পর্কে কোনো নথিপত্র তৈরি বা সংরক্ষণ করারও প্রশ্ন আসে না। তাই ভুল চিকিৎসায় বা চিকিৎসাক্ষেত্রে অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু বলে যে একটা ব্যাপার আছে, বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তার অস্তিত্ব নেই। তা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এ রকম: বাংলাদেশে চিকিৎসকেরা ভুল করেন না, অবহেলা তো নয়ই!
প্রসঙ্গটি উঠল একজন প্রতিভাবান মানুষকে অপ্রত্যাশিতভাবে হারানোর কারণে। তিনি সংগীতশিল্পী, সংগীত-গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সিনেমাটোগ্রাফার-সাংবাদিক মিশুক মুনীরকে হারিয়ে জাতি যখন শোকগ্রস্ত, সংবাদমাধ্যমের প্রায়-সমস্ত মনোযোগই যখন তাঁদের ঘিরে দেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশার প্রতি, তখন মাত্র দুই দিন ডায়রিয়ায় ভুগে মারা গেলেন মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী। আক্রান্ত অবস্থায় তাঁকে রাজধানীর অন্যতম বেসরকারি হাসপাতাল ল্যাবএইডে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তিনি সুস্থ হননি, প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ভুল চিকিৎসায় ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ তাদের চিকিৎসকদের ভুল বা চিকিৎসায় দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ স্বীকার করেনি।
অধ্যাপক মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী সাধারণ কেউ হলে এ ঘটনা হয়তো সংবাদমাধ্যমে স্থান পেত না। তাঁর আত্মীয়স্বজনের শত বিলাপ, শত অভিযোগ নিষ্ফলভাবে মিলিয়ে যেত বাতাসে। মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর এই আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে তাঁর পরিবারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েন; তাঁরা এই মৃত্যুর জন্য দায়ী চিকিৎসকদের নাম প্রকাশ, ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে তাঁদের বহিষ্কারের দাবি জানান। তাঁরা আরও দাবি করেন, ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষকে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে এবং মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর পরিবারকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়; এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ল্যাবএইড হাসপাতালের চেয়ারম্যান, সব পরিচালক, প্রধান কনসালন্ট্যান্ট ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে তলব করেন। ২৩ আগস্ট আদালতে হাজির হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা চিকিৎসায় অবহেলার বা দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে। এসব চাপের মুখে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছে, কিন্তু তারা বলছে, ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে তারা এ টাকা দেয়নি, দিয়েছে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার তহবিল থেকে ‘সহায়তা’ হিসেবে। অর্থাৎ, ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ তার আগের অবস্থানেই অটল রয়েছে—মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর চিকিৎসায় তাদের কোনো ভুল বা অবহেলাজনিত কালক্ষেপণ/ দীর্ঘসূত্রতা ছিল না।
ডায়রিয়া-আক্রান্ত মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীকে সোমবার সকাল পৌনে ১০টায় ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়া থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় তাঁকে মৃত ঘোষণা করা পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ দুই পক্ষে দুই রকম। তবে তাঁর চিকিৎসা-প্রক্রিয়া ও মৃত্যু সম্পর্কে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে দিয়েছে, সেখানে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘তাঁকে (মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী) আইসিইউতে ভর্তি হতে বলা হলেও পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা বিলম্ব হয়।’ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত, পানিশূন্যতায় মুমূর্ষু একজন রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব তাঁকে বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার, তা-ই করা। ভর্তিসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতায় কালক্ষেপণের ফলে রোগীর মৃত্যু হলে ইমার্জেন্সি বা জরুরি চিকিৎসার থাকল কী? এ রকম আনুষ্ঠানিকতা শুধু ল্যাবএইড কেন, পুরো দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাতেই এক বিরাট সমস্যা। কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আগে টাকা নেয়, তারপর রোগীর দিকে তাকায়। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষ চিকিৎসক ও সেবক-সেবিকাদের অবহেলা-অমনোযোগের শিকার হয়। এ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশি আছে; সংবাদকর্মীদের লেখায় সে বিবরণ যথেষ্ট হবে না। সাধারণ মানুষ অসহায়, অসাধারণ যাঁরা, তাঁরাও যে ভুল চিকিৎসায় স্বজনের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ পান, তা নয়।
কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা সতর্ক হওয়ার সুযোগ এনে দেয়। ল্যাবএইডের এ ঘটনা বাংলাদেশের সব চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক ও ব্যবস্থাপকদের জন্য সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। সতর্ক হতেই হবে, রোগীদের প্রতি মনোযোগ দিতেই হবে। চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউই রোগীর মৃত্যু কামনা করে না বটে, কিন্তু রোগীর প্রতি মনোযোগের অভাব বা অবহেলা থাকলে এমন ভুলত্রুটি ঘটে যেতে পারে, যা রোগীর মৃত্যু ডেকে আনে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ব্যবস্থাপক ও চিকিৎসকেরা যদি মনে করেন চিকিৎসা শুধু ব্যবসা, ঠিক আছে, সেই ব্যবসাটাই আপনারা ভালোভাবে করুন, সৎভাবে করুন। মানুষ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে আপনাদের কাছে চিকিৎসা কিনতে যায়, বিনা পয়সায় সেবা নিতে যায় না। মানুষ জানে এবং মানে, আপনারা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি খুলে বসেননি, টাকা বানাতে নেমেছেন। তো টাকা আপনারা বানান, কিন্তু সে টাকার বিনিময়ে রোগীকে মানসম্মত চিকিৎসা দেবেন না কেন? কেন রোগীর প্রতি অমনোযোগ? কেন অবহেলা?
আর চিকিৎসা-ব্যবসাটা যদি আপনারা ভালোভাবে করতে চান, ভুলত্রুটি হলে স্বীকার করুন, বিশ্লেষণ করে দেখুন কী কী ভুল হয়েছে। এ দেশে ওষুধের বেঠিক ব্যবহার, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, একাধিক ওষুধের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার বিরূপ প্রভাব ইত্যাদি নিরূপণের চর্চা নেই। ডায়রিয়া-আক্রান্ত মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী ল্যাবএইড হাসপাতালে যখন পৌঁছান, তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা এমন ছিল যে তিনি হাঁটতে পারছিলেন। সেই রোগীই মাত্র দেড় ঘণ্টা পরে কেন মারা গেলেন—এটা কি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় নয়? কিন্তু সে রকম উদ্যোগ কি নেওয়া হবে? সংবাদপত্রে প্রকাশিত ল্যাবএইডের দেওয়া চিকিৎসার বিবরণ পড়ে একজন চিকিৎসক টেলিফোনে মন্তব্য করলেন: ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা আন্তক্রিয়ার (ড্রাগ ইন্টার-অ্যাকশন) ফলে মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর মৃত্যু ঘটে থাকতে পারে। তাঁরা বলছেন, রোগীর হাইপার ক্যালিমিয়া ছিল, অর্থাৎ রোগীর কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছিল না; ফলে অন্যান্য উপসর্গের পাশাপাশি হঠাৎ হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগী মারা গেছেন। কিন্তু রোগীর কিডনির কাজ ব্যাহত হচ্ছিল কখন থেকে? তাঁকে ওষুধ দেওয়ার পরই তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটে। ডায়রিয়া রোগীর পটাশিয়ামের মাত্রা যেখানে কমে যায়, সেখানে তাঁর বেড়ে গিয়েছিল কেন—এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার। যেসব দেশ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ও চিকিৎসাব্যবস্থায় উন্নতি করেছে, তারা নিয়মিতভাবে এ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে। ভুল চিকিৎসার নথিপত্র তারা সংরক্ষণ করে, বিশ্লেষণ করে। মৃত রোগীদের রোগের বিবরণ, ব্যবহূত ওষুধপত্রের উল্লেখসহ চিকিৎসার পুরো বিবরণ তারা নথিভুক্ত করে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা সেগুলো কেস স্টাডি হিসেবে পাঠ করেন, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর প্রাণের বিনিময়ে যদি আমাদের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের মধ্যে এই বোধোদয় ঘটে যে তাঁদের কাজ বা ব্যবসা মানুষের প্রাণ ও স্বাস্থ্য নিয়ে, যদি তাঁদের মনে এই উপলব্ধি জাগে যে মানুষের প্রাণের মূল্য ৫০ লাখ কেন, কোনো অঙ্কের টাকাই হতে পারে না, তবেই মঙ্গল। এই বাবদে আমাদের সরকার বাহাদুরেরও টনক নড়া উচিত: বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো মনিটর করা সরকারেরই দায়িত্ব। নজরদারি ও জবাবদিহির সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে থেকে কোনো ব্যবস্থাকেই চলতে দেওয়া উচিত নয়; চিকিৎসাব্যবস্থার মতো জরুরি ব্যবস্থাকে তো নয়ই।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.