নিরাপদ সড়ক-আর কত মৃত্যু হলে সরকারের টনক নড়বে? by আবদুল মান্নান

১৩ আগস্ট ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে একটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের সাধারণ মানুষ এখন শোকাভিভূত। এই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, যাঁদের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আর অন্যজন একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী-নাট্যকার, আমাদের শিক্ষক মুনীর চৌধুরীর ছেলে বিশিষ্ট টিভি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী মিশুক মুনীর, পুরো নাম আশফাক মুনীর চৌধুরী।


সঙ্গে আহত হয়েছেন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, অনুজপ্রতিম আমার সহকর্মী শিল্পী ঢালী আল মামুন ও তাঁর স্ত্রী দিলারা বেগম জলি। ১৪ তারিখ রাতে মামুনের একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে, তবে সে এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় স্কয়ার হাসপাতালে গিয়েছিলাম আহত ব্যক্তিদের খোঁজখবর নিতে এবং নিকটজনদের সমবেদনা জানাতে। দেখা হলো অনেকের সঙ্গে। সবাই শোকাভিভূত।
সম্ভবত ১৯৯৮ সালে মামুন একবার আমার কাছে তার বন্ধু তারেক মাসুদকে নিয়ে এসেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মুক্তির গান-এর একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চায়। ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের দৌরাত্ম্যের কারণে তখন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো অনুষ্ঠান করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তাদের বলেছিলাম, প্রদর্শনীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব ধরনের সহায়তা করবে। পরে খুবই শান্তিপূর্ণভাবে গ্রন্থাগার মিলনায়তনে মুক্তির গান প্রদর্শিত হয়েছিল, যদিও আমার পক্ষে সে সময় তা দেখার সুযোগ হয়নি। অবশ্য পরবর্তীকালে তারেক মাসুদের সব কটি ছবি আমি ভিডিওতে দেখেছি এবং এই ভেবে স্বস্তি বোধ করেছি যে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে প্রস্তুত। তাদের শুধু একটু জায়গা ও সুযোগ করে দিতে হবে। গত এক দশকে আমি যখনই দেশের বাইরে গেছি, তখনই বন্ধুবান্ধবের জন্য তারেক মাসুদের ছবির সিডি সঙ্গে নিয়েছি। মিশুককে দেখেছি অনেক আগে, যখন সে হয়তো স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে প্রবেশ করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফুলার রোডের তাদের বাসার সামনে ক্রিকেট খেলতে। ৩২ নম্বরের একই ভবনে থাকতেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্যারের বাসায় যাওয়ার সময় দেখতাম, বেশ কিছু কিশোর সামনের চত্বরে ক্রিকেট খেলছে। একদিন ভাবি ওপর থেকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ও মিশুক, শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে, খুবই প্রতিভাবান। বড় হওয়ার পর আর কখনো মিশুককে দেখিনি। তার মৃত্যুর পর তার যত সব তাক লাগানো কীর্তির কথা জানা গেল। মিশুক কিছুটা প্রচারবিমুখ ছিল। ‘মৃত্যুর পর এটিএন বাংলার জ ই মামুন, মুন্নী সাহাসহ অনেকে যখন মিশুকের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বারবার তাকে স্যার বলে সম্বোধন করছিল, তখন কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, মিশুক এদের পেশায় কত বড় মাপের শিক্ষক ছিল। তারেক এবং মিশুক দুজনেই ইউরোপ-আমেরিকায় দীর্ঘদিন কাটিয়েছে। ইচ্ছা করলে সেসব দেশে থেকে যেতে পারত, যেমনটা অনেকে করে, কিন্তু তা তারা করেনি। মাটির টানে তারা দেশে এসে দেশটাকে তাদের কর্মক্ষেত্র বানিয়েছে এবং সফল হয়েছে। কিন্তু শেষতক তাদের সফলতার পথটাকে রুদ্ধ করে দিল একটি ঘাতক বাস। নিহত ব্যক্তিদের পারিবারিক ক্ষতি তো বটেই, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি জাতির। আর একজন তারেক মাসুদ বা মিশুক মুনীর পেতে বাংলাদেশকে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, তা বলা কঠিন।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর বাংলাদেশে যত মানুষ প্রাণ হারায়, তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে ঘটে না। এই হিসাব কারও মতে ১২ হাজার, কেউ বলেন ১৫ হাজার। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নানাবিধ, যার মধ্যে আছে যানবাহনের চালকদের অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কের বেহাল দশা, রাস্তায় প্রয়োজনীয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সিগন্যাল না থাকা, রাস্তার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা অধিক হওয়া, অদক্ষ ট্রাফিক পুলিশ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সাধারণ জনগণের সড়কে চলাচল সম্পর্কে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা বা জানা না থাকা। তবে সবকিছুর ওপর স্থান দিতে হবে বিআরটিএর একশ্রেণীর কর্মকর্তার লাগামহীন দুর্নীতি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্য-আনাড়ি চালকদের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দেওয়া এবং তার সঙ্গে আছে লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়িকে চলাচলের উপযোগী বলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বর্তমানে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নৌমন্ত্রীর চাপে কোনো পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার উৎসব। অভিযোগ যদি সত্য হয়, তা হলে এর চেয়ে উদ্বেগজনক সংবাদ আর কিছু হতে পারে না। এমন ব্যবস্থায় লাইসেন্স দেওয়ার অর্থ হচ্ছে চালক নামের একজন ঘাতককে মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া। অন্য দেশে ট্রাফিক আইন পালন নিয়ে দুটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির বড় ছেলে জুনিয়র কেনেডিকে একবার জোরে গাড়ি চালানোর দায়ে ওয়াশিংটন ডিসির এক পুলিশ সদস্য রাস্তায় থামিয়ে ফাইন করলেন। ডিউটি শেষে রাতে তিনি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলেন, তিনি যাঁকে ফাইন করেছেন, তাঁকে চেনেন কি না? ঝটপট উত্তর এল, তার কি প্রয়োজন ছিল?
দ্বিতীয় ঘটনাটি গত মে মাসের। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন লন্ডনে। তাঁকে বহন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছিল তাঁর বিশেষ লিমুজিন ‘দি বিস্ট’ (Beast) ও অন্যান্য গাড়ি। বিস্ট আবার এত ভারী যে সেটি খুব বেশি দ্রুতগতিতে চলতে পারে না। লন্ডনের সড়কগুলো তেমন চওড়া নয়। অনেকটা আমাদের ঢাকার রাস্তার মতো। তবে সেখানে চালকেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে জনগণের ভোগান্তিটা কম। ওবামাকে বহনকারী গাড়িবহর এক জায়গায় এসে একটু যানজটের সৃষ্টি করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে তা ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ইউরোপ-আমেরিকায় সড়কের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যামেরা বসানো থাকে। কেউ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করলেই ক্যামেরায় তা গাড়ির নম্বরসহ ধরা পড়ে এবং আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আইন তো সবার জন্য সমান। হোক না তিনি বারাক ওবামা। গাড়িবহরকে ১০ পাউন্ড ফাইন করা হলো। সময়মতো তা পরিশোধ না করার কারণে তা এখন ১২০ পাউন্ডে দাঁড়িয়েছে। ওবামার সম্মানে রাতে রানির দেওয়া ভোজসভায় তাঁর সঙ্গে দেখা হলো লন্ডনের মেয়র বরিস জনসনের। বরিস একসময় জাঁদরেল সাংবাদিক ছিলেন (The Spectator Magazine-এর সম্পাদক, ১৯৯১-২০০৫)। উঠে গিয়ে ওবামার সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে চুপিসারে তাঁকে জানিয়ে দিলেন তাঁর গাড়িবহরকে জরিমানা করার কথাটা। আশা করা হচ্ছে, লন্ডনে মার্কিন দূতাবাস এই জরিমানা দ্রুত পরিশোধ করবে, যদিও তারা সব সময় জরিমানার ক্ষেত্রে ১৯৬০ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ধুয়া তোলে। এযাবৎ তারা তাদের এই অজুহাত দেখিয়ে সফল হতে পারেনি।
বাংলাদেশে কি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে এমন কোনো আইন নেই? আছে, তবে তা কদাচিৎ প্রয়োগ করা হয়। শুরুটা করতে হবে সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার বাধ্যবাধকতা চালু করা দিয়ে। অমি প্রতিদিন সাতমসজিদ রোডে অনেক লেগুনার চালককে গাড়ি চালাতে দেখি, যাদের অনেকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক। অনেক সময় তারা কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে গান শোনে আর গাড়ি চালায়। এই সড়কে কয়েকটি স্কুল আছে কিন্তু ট্রাফিক সার্জেন্ট দেখা যায় কদাচিৎ। ছায়ানট আর শংকরের মধ্যে সংযোগের জন্য একটি ফুটওভারব্রিজের দাবি বহুদিনের। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবনটা হাতে নিয়ে এখানে রাস্তা পার হয়। যুক্তরাষ্ট্রে সব চালকের লাইসেন্সে কতগুলো পয়েন্ট জমা থাকে। ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করলে প্রতিবার পয়েন্ট কাটা যায়। একসময় পুরো লাইসেন্স স্থগিত করে দেওয়া হয়। নিয়মভঙ্গের মাত্রা বেশি হলে লাইসেন্স বাতিলও হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে একজন গাড়ির চালক যতই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করুক, তার লাইসেন্স কখনো স্থগিত বা বাতিল হয় না। লাইসেন্স দেওয়ার সময় শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার নিয়ম আছে। বাংলাদেশে তা কখনো করা হয় না, আর হলেও তা হয় দায়সারা গোছের। মানুষের মধ্যে সড়কে চলাচলের সময় সাধারণ নিয়মকানুন মানার কোনো প্রবণতা দেখা যায় না। এখানে রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপারে আমরা বেশ উদাসীন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হওয়া নিত্যদিনের দৃশ্য। ফুটওভারব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহারে পথচারীদের অনীহা প্রচণ্ড। আর দেশের সড়কগুলোর অবস্থা যত কম বলা যায় ততই ভালো। গত কয়েক দিন ঢাকার সঙ্গে দেশের অনেক অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। কারণ, বাসমালিকেরা যানবাহন চলাচলের অযোগ্য সড়ক দিয়ে গাড়ি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তাঁদের কি খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে? যোগাযোগমন্ত্রী পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না থাকার অজুহাত দিয়েছেন। জনগণ তো কোনো অজুহাত শুনতে চায় না। তাদের সোজা কথা, যে কাজের জন্য আপনাকে মন্ত্রী বানানো হলো, সে কাজ করতেই যদি ব্যর্থ হন, তাহলে আর মন্ত্রী থাকা কেন? দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা খুবই সামান্য। ওই সামান্য চাহিদা পূরণ হলেই তারা সন্তুষ্ট।
তারেক মাসুদ বা মিশুক মুনীরের অকালে চলে যাওয়া নিয়ে কদিন সবাই হা-হুতাশ করবে। হয়তো কয়েক দিন বিনা পরীক্ষায় লাইসেন্স দেওয়ার চাপ দেওয়া থেকে নৌপরিবহনমন্ত্রী বিরত থাকবেন। কিন্তু সময়ের আবার সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। আবার হয়তো আমরা আরেকজন তারেক মাসুদ বা মিশুক মুনীর হত্যার জন্য অপেক্ষা করব। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পুরো বিষয়কে একটা সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং অন্তত বিদ্যমান আইনগুলো যাতে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তার জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। আর আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রীর মতো আরও যাঁরা আইনকানুন মানতে চান না, সরকারকে তাঁদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা সম্ভব হলে জনগণ ছাড়াও লাভ কিন্তু সরকারেরও কম নয়। সব শেষে নিরাপদ সড়ক চাই, জীবনের নিশ্চয়তা চাই।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.