সদরে অন্দরে-ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হওয়া না হওয়া by মোস্তফা হোসেইন

গত জানুয়ারি মাসের শেষ দিকের ঘটনা। সময়টা সন্ধ্যার পরপর। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে হলো অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে। স্নেহের ভাতিজি ইমার্জেন্সিতে। কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে মারাত্মক আহত হয়ে ভর্তি হয়েছে। পৌঁছে জানা গেল, রোগী অপারেশন থিয়েটারে।


কোথায় অপারেশন থিয়েটার? সে যে লঙ্গরখানা! মাথায় সেলাই করছেন চিকিৎসক। আয়া, বুয়া, রোগিণীর সহযোগী মিলে জনা দশেক মানুষ অপারেশন থিয়েটারের ভেতর। অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনে লঙ্গরখানার মানুষদের মতো খাবার নিয়ে হৈচৈ, হুড়োহুড়ি। করিডোর দিয়ে মানুষ চলাচল বন্ধ খাবার রাখা টেবিল থাকার কারণে।
রোগিণীকে আইসিইউতে ভর্তি করতে হবে দ্রুত। ডিএমসিএইচএ জায়গা খালি নেই। দালাল এলো একজন- ১৫ হাজার টাকা চাইলো আইসিইউতে সিট ব্যবস্থা করে দেবে বলে। রুচিতে মেলেনি আমাদের। সিদ্ধান্ত হলো, প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু স্ট্রেচার বের করা যাচ্ছে না খাবারপ্রত্যাশী মানুষগুলোর জটলা আর হৈচৈয়ের কারণে। এর মধ্যে দুজন ভাতের গামলা নিয়ে দ্রুতবেগে ঢুকলো অপারেশন থিয়েটারের ভেতর।
এই আজব জায়গা থেকে সরে যাওয়াই বেহেতর। ধাক্কাধাক্কি করে খাবার রাখা টেবিল সরিয়ে স্ট্রেচার বের করে নিয়ে আসতে হলো। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে যত বিছানা, তার চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ হবে রোগী। দুজন চিকিৎসক গলদঘর্ম দৌড়াদৌড়ি করতে করতে। বারান্দা ও ওয়ার্ডে রোগীদের কাতরানো দেখে বুক কাঁপবে না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন।
আর আমাদের বুক কাঁপিয়ে দিল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রীটির অকাল প্রয়াণে। এই হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমাদের পরিবারের সবার মনে দগদগে দাগ ফেলে দেয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা, ব্যবস্থাপনা এবং এর আনুষঙ্গিক দিক। এমন সময় আলোচনায় এসেছে মেডিক্যাল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার বিষয়টি। এরই মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে দুটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি? যদি বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়, তাহলে দেশের চিকিৎসা সুবিধায় কী কী ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে? লেখার শুরুতে যে ব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা গেল, তার কি পরিবর্তন হবে? যদি সরকারের এই উদ্যোগ কার্যকর না হয়, তাহলেও বা বাংলাদেশ এই খাতে অগ্রগতির পথে কতটা বাধাগ্রস্ত হবে। প্রশ্নগুলো সামনে আসছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।
বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া জরুরি নয় বলে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের বক্তব্য- এখানে যেসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, তাঁরা সারা দেশে আসা-যাওয়া করতে বাধ্য হন পেশাগত কারণে। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেই শিক্ষকরা কি আর বাইরে বদলি হয়ে যেতে পারবেন? তাহলে যে ঢাকার বাইরের চিকিৎসাপ্রার্থীরা উন্নত চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎকদের বিকেন্দ্রীকরণ সুবিধা বাদ যাবে। তারা গরিব মানুষের চিকিৎসা সুবিধার প্রসঙ্গটি টেনে আনেন। সংগত কারণেই ডিএমসিএইচএ অধিক সংখ্যক রোগীর চিকিৎসার বিষয়টি আনা হচ্ছে। প্রতি বেডে একাধিক রোগী ভর্তি করা হয়, বারান্দায় রেখেও চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলে কি সেই সুযোগ অব্যাহত থাকবে? তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির বিরোধিতা না করলেও বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বাইরে অন্য কোনো মেডিক্যাল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে তো আর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই। এখন এখানে এমএস কিংবা এমডি পর্যায়ে যত শিক্ষার্থী লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর আর সেই সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষার সুযোগ পাবে না। সংখ্যা কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। এখন সরাসরি সরকারের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়, যে কারণে সরকারি প্রতিশ্রুতি এবং জনচাহিদা বিবেচনা করে সেবাকে যেভাবে গরিব মানুষের স্বার্থে সম্প্রসারিত রাখা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় হলে তা সম্ভব হবে না। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, সেখানে সেবার দিকে তাদের মনোযোগ কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
আজকে সারা দেশের মানুষ কিছু হলেই দৌড়ে আসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বিষ খেয়েছে কিংবা খাওয়ানো হয়েছে, পুড়ে গেছে কিংবা দুর্ঘটনা ঘটেছে- মানুষ কিন্তু দৌড়ে আসে শেষ চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে এখানেই। প্রশ্ন হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ইমার্জেন্সি নেই, ও রকমই ইমার্জেন্সি যদি এখানে না থাকে, তাহলে গরিব মানুষের জীবনে বড় একটি আঘাত হবে না? তারা সহজে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য কোথায় যাবে? এখানকার চিকিৎসা সেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু এখানে এসে যে অসংখ্য মানুষ জীবন বাঁচাতে পারছে, এটা তো স্বীকার করতে হবে। এখানে প্রচুর প্রশিক্ষণার্থী আছে। তাদের কাছ থেকে রোগীরা সেবা পাচ্ছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় করে সাধারণ মানুষের কী লাভ হবে, তা ভেবে দেখতে হবে।
কিন্তু আমরা যদি ভিন্ন দিকটি ভেবে দেখি, তাহলে স্পষ্টত মনে হবে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলে মনে হয় তেমন অসুবিধা হবে না। বরং সামগ্রিক চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে সারা দেশে চিকিৎসা সুবিধা আধুনিক হওয়ার সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে ডিএমসিএইচকে না করে অন্য মেডিক্যাল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য যাঁরা প্রস্তাব করছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়- এটা যৌক্তিক হবে না। যেমন, চট্টগ্রামে মানববন্ধন হলো চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি নিয়ে- সেটা তা কি এই মুহূর্তে সম্ভব? এই মুহূর্তে অবকাঠামোগত সুবিধার কথা চিন্তা করতে হলে ডিএমসিএইচএর তা বেশি আছে। এখানে স্মাতকোত্তর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে পড়ানোর শিক্ষক এখানেই কাজ করছেন এখন। আবার, রোগীর কথা যদি বলা হয়, তাহলেও দেখা যাবে বর্তমান ডিএমসিএইচএ অনেক বেশি। এখানে গবেষণা সুবিধাও অনেক বেশি। মেডিক্যাল কলেজ হওয়ার পরও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের লেখাপড়া এখানে নিত্য হচ্ছে।
যারা মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় হলে ইমার্জেন্সি সুবিধা হ্রাস পাবে, তাদের এই দুশ্চিন্তাকে অবশ্যই আমলে আনতে হবে। আবার আউটডোর সুবিধার বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। ডিএমসিএইচএ সাধারণ মানুষের যে চিকিৎসা সুবিধা বর্তমান আছে, তা অব্যাহত রাখা গেলে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরও সুবিধা সম্প্রসারিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হলে যে চিকিৎসা সুবিধার বিষয়টি সঙ্কুচিত হয় না, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আগেও ইমার্জেন্সি ছিল না। ফলে এখানে ইমার্জেন্সি না থাকার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বঙ্গবন্ধুতেও ইমার্জেন্সি খোলার সুযোগ সম্প্রসারিত করা যায় কি না সেই বিবেচনা করা যেতে পারে। ডিএমসিএইচ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে এখান থেকে বিশেষজ্ঞরা বেরিয়ে সেবায় নিয়োজিত হবেন সারা দেশে। সুতরাং চিকিৎসা সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণে প্রতিবন্ধকতা হবে বলে যা মনে করা হচ্ছে, তাও কতটা যৌক্তিক। এখন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা যে দুশ্চিন্তা করছেন, তাঁদের বিষয়টিও বিশ্লেষণ করতে হবে। একই অবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। তখনো তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয় করার ব্যাপারে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হলে তাঁদের চাকরির সুবিধাও বাড়বে। কারণ, আজকে যেমন তাঁদের বদলির চিন্তা করতে হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয়, তখন তা প্রয়োজন হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আজকে কোনো পদোন্নতির জন্য যেমন ২৫ বছরও অপেক্ষা করতে হয়, তখন তা করতে হবে না। কারণ, সে সময় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিজেদেরই দেওয়ার সুযোগ থাকবে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনকার মতো থাকবে না।
ডিএমসিএইচকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ব্যাপারে আপত্তি না দেখিয়ে বরং সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সুবিধা যাতে আরো সম্প্রসারিত হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। আর সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় হলেই সেবা বিঘি্নত হবে, এমনটা ঠিক নয়। দায়িত্বসচেতনতা না বাড়লে কলেজ রেখেও বর্তমান অবস্থার চেয়ে বেশি সেবা নিশ্চিত করা যাবে না।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.