পাকিস্তান-নতুন প্রদেশ ভাবনা by আই এ রেহমান

পাকিস্তানের রাজনৈতিক গ্লাডিয়েটররা এখন নতুন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এবার তাঁদের যুদ্ধ নতুন প্রদেশ গঠন বিষয়ে। পিপিপি ও পিএমএল-এন যখন তাদের মিত্র ও সমর্থকদের মতামত জানতে চাইছে, সেই সময় পিএমএল-কিউ তড়িঘড়ি করে পাঞ্জাব আইনসভায় প্রস্তাব পেশ করে বসেছে পাঞ্জাবের দক্ষিণাংশের কয়েকটি জেলা নিয়ে


স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করার জন্য। এ দলটি বর্তমানে কেন্দ্রে শাসক জোটের অংশীদার। ক্ষমতাসীন পিপিপির অবস্থান থেকে তাদের অবস্থানের পার্থক্য স্পষ্ট করতে তারা প্রস্তাবিত প্রদেশটিকে সেরাইকি নামে ডাকা থেকে বিরত থাকছে। তারা বলছে, এ পদক্ষেপ প্রশাসনিক কারণেই নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অবশ্য যদি নতুন প্রশাসনিক ইউনিট গঠনের দাবি করে, তাহলে কোনো নীতিগত অবস্থানই এর বিরুদ্ধে টিকতে পারবে না। তথাপি, এমন দাবি তোলা হলে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়, তা-ও অগ্রাহ্য করা যায় না। সমস্যাগুলো একাধিকবার চিহ্নিত হয়েছে; সেসবের পুনরাবৃত্তি অপ্রাসঙ্গিক নয়।
প্রথম সমস্যা, আমাদের অতি পরিশ্রমী রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিটি বিষয়কে মতাদর্শিক চেহারা দেওয়ার প্রবণতা। ইসলামি মতাদর্শ অথবা পাকিস্তানি মতাদর্শ অথবা উভয় মতাদর্শের পরম্পরাগত জিম্মাদারেরা নিশ্চিতভাবেই কোনো প্রদেশকে ভাষাগত কিংবা জাতিগত ভিত্তিতে বিভক্তির বিরোধিতা করে। তারা মিল্লাতের ধারণায় এতই মোহাচ্ছন্ন যে বৃহৎ মিল্লাতের ভেতরে বৈচিত্র্যময় মুসলমান জাতিগুলোর অস্তিত্ব তাদের কাছে অভিশপ্ত বস্তু। পাকিস্তান ফেডারেশনের ভেতরে বিভিন্ন ইউনিটের অস্তিত্বে তারা অস্বস্তি বোধ করলেও মেনে নেয়। পাকিস্তানকে একটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত ঐকিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে তাদের আকুলতা মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
এসব ভাবাদর্শী সময়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। দুনিয়া জুড়ে রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে জোরালো প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে জাতিগত ও ভাষাগত পরিচয়। আর যেখানেই রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও স্বার্থের যথাযথরূপে জায়গা করে দেওয়া যায়নি, সেখানে তা আরও বেশি প্রযোজ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রদেশ ঘোষণার দাবিতে সব আন্দোলনের (বোম্বে থেকে সিন্ধু পৃথক্করণ এবং তৎকালীন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত প্রদেশকে পূর্ণ গভর্নরের প্রদেশে উন্নীতকরণের আন্দোলনসহ) শিকড় গাঁথা ছিল জনগণের জাতিগত ও ভাষাগত আকাঙ্ক্ষার ভেতরে। যদিও জনগণের বিশ্বাসের কথাও কখনো কখনো উঠে এসেছে। ভারতের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়, ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাঞ্জাবকে ভাগ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশ গঠন এবং বিহারের গর্ভ থেকে ঝাড়খন্ডের জন্ম এবং শক্তিধর উত্তর প্রদেশ থেকে উত্তরখন্ড প্রদেশের আবির্ভাব—সব ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের শুধু বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঐক্য—এ ধারণা পুনর্মূল্যায়ন করার এবং রাজনৈতিক ইস্যুকে রাজনৈতিক সমন্বয়ের ব্যাপার হিসাবে নেওয়ার হয়তো সময় এসেছে। সমাজের বহুত্ববাদী চরিত্রকে দেখতে না পারার বদলে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করাই হবে পাকিস্তানের জন্য মঙ্গলজনক।
এ কথা সত্য যে পাঞ্জাবের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সেরাইকিকে পাঞ্জাবি উপভাষার অধিক কিছু মনে করেন না। আবার সেরাইকিরা স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী—এমন দাবিও তারা মানে না। এসব বিষয়ে বিতর্ক জারি আছে কয়েক দশক ধরে। সেরাইকিদের বর্তমান দাবিদাওয়ার ওপর এসব বিষয়ের ফয়সালা কি চূড়ান্ত ছাপ ফেলবে?
আজ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সেরাইকি জনগণের দারিদ্র্য ও তাদের বঞ্চনা। এই অঞ্চলের তারা ঐতিহ্যগত চাষি। অথচ শত শত বছর ধরে তাদেরই ভুখা থাকতে হয়েছে মধ্য ও দক্ষিণ পাঞ্জাবের মানুষের মতো তারা ব্যবসা কিংবা চাকরিতে যায়নি। আর এখন তারা ব্যবসায়-চাকরিতে তাদের হিস্যা দাবি করছে। তাদের জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক স্বার্থের ভিত্তিতে এটা ন্যায্য রাজনীতি।
প্রসঙ্গক্রমে, পাঞ্জাবের প্রদেশশাসিত উপজাতীয় অঞ্চলের ডেরা গাজি খান জেলায় বসবাসরত দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ও একদম অবহেলিত মানুষের ভাগ্যের কী হবে? বালুচভাষী এসব মানুষ তাদের বহু বছর আগেই ব্যক্ত ইচ্ছানুযায়ী বেলুচিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতে পারবে না কেন?
সেরাইকি প্রদেশের দাবির সমর্থকদের সেসব মানুষকে নিয়ে সমস্যায় পড়তে হতে পারে, যারা পূর্বতন বাহাওয়ালপুর রাজ্যকে স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করার দাবি করছে। যতক্ষণ পিপিপি এসব মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার পথ খুঁজে না পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেরাইকিদের মধ্যকার বিভক্তিতে পিপিপিকে যথেষ্ট নাস্তানাবুদ হতে হবে।
এখন কিছু সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। প্রথমত, নতুন প্রদেশ সৃষ্টি সিনেটের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা পরীক্ষা করতে হবে। সিনেটে (ইসলামাবাদ বাদে) বর্তমানে বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশের আসন বা ক্ষমতার ভাগ ২৫ শতাংশ। যগি গিলগিট-বাল্টিস্তানকে প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং হাজারা ও সেরাইকি প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়, তবে সিনেটে এসব প্রদেশের ভাগীদার (পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখা) বাদবাকি অংশের ভাগীদারের পাশাপাশি ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১৪ শতাংশে দাঁড়াবে। ফেডারেশনের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাবে সেরাইকি ও হাজারাওয়ালরা পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখার পাশে আছে না নেই, তার ওপর ভিত্তি করে। দ্বিতীয়ত, নতুন প্রদেশগুলোতেও যদি আজকের প্রদেশগুলোর মতোই মাথাভারী প্রশাসন থাকে, তাহলে দেশের অনুৎপাদনশীল ব্যয় আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে এ প্রকার ব্যয় যৌক্তিক সীমা অতিক্রম করেছে। তখন এর পরিণতিতে ঘটবে অকল্পনীয় অর্থনৈতিক সংকট।
তৃতীয়ত, যথাযথ ক্ষমতায়িত ইউনিট নিয়ে ফেডারেশন গঠনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবে শুরু করেছে পাকিস্তান। প্রদেশগুলো যে পরিমাণ প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্জন করেছে, তা থেকে লাভবান হওয়ার সামর্থ্য এদের আছে কি না, সে ব্যাপারে বিলক্ষণ দুশ্চিন্তা রয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন প্রদেশের সামর্থ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তাই আরও যুক্তিসংগতভাবেই তোলা যায়।
নতুন প্রদেশ গড়ার প্রস্তাবের ব্যাপারে আগাগোড়া বিতর্কের আবশ্যকতা অত্যন্ত পরিষ্কার। এখন হয়তো পাকিস্তানের দরকার প্রতিটি প্রদেশে ছোট আকারের প্রশাসনিক উপরিকাঠামো—ক্ষুদ্রাকার আইনসভা ও সচিবালয়; আর ক্ষমতার ডালপালা আমূল ছেঁটে ফেলা। সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়, যেদিন কেন্দ্রীয় হিস্যার ওপর নির্ভর না করে প্রদেশগুলোর নিজস্ব সংবিধান ও সম্পদ সৃষ্টির নিজস্ব পরিকল্পনা দরকার হবে।
নতুন প্রদেশবিষয়ক বিতর্কে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে। এক দৃষ্টিতে, নতুন প্রদেশ গড়া এবং তাদের সার্বভৌমত্ব বিষয়ে এসব কথাবার্তা তখনই প্রাসঙ্গিক হবে, যদি রাষ্ট্র জঙ্গিবাদীদের চ্যালেঞ্জ পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। জঙ্গিবাদীরা তো প্রদেশ কিংবা গণতান্ত্রিক সংবিধানের কোনোটাতেই বিশ্বাসী নয়। অন্য দৃষ্টিভঙ্গিটি হলো, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন করা এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণ করা হলে রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে এবং জঙ্গিবাদীদের পরাস্ত করতে সক্ষম হবে। দুই দৃষ্টিভঙ্গির কোনটি সুখের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে, তা সময়ই বলে দেবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আই এ রেহমান: পাকিস্তানের কলাম লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.