নদী সংযোগ প্রকল্প-ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক by রামাস্বামী আয়ার

সুপ্রিম কোর্টেরই উচিত ছিল সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাওয়া যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কী? তারা কি দেশের প্রয়োজনে এই প্রকল্পকে উত্তম অথবা একমাত্র সমাধান বলে মনে করে? যদি তাই হয়, তারা কি এ নিয়ে অগ্রসর হতে চায়; অথবা বিকল্প কিছু রয়েছে? যদি থাকে, সরকার কি এই ধারণা পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে? যদি নিয়ে থাকে, তার ভিত্তি কী?
তা না করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের মোটেই উচিত হয়নি
সাম্প্রতিককালে ধারাবাহিক কিছু স্মরণীয় সিদ্ধান্তের কারণে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট আমাদের প্রশংসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছিল। কিন্তু হায়! আন্তঃনদী সংযোগ (ইন্টার লিঙ্কিং অব রিভারস-আইএলআর) প্রকল্প নিয়ে একটি অস্বাভাবিক রায় দিয়ে আমাদের অনেককে আতঙ্কিত ও হতাশ করেছে।
আগেও হাইকোর্ট থেকে এমন একটি আদেশ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু আদেশদাতা জাস্টিস কিরপাল অবসর গ্রহণের পর ২০০২ সালে এক ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, আন্তঃনদী সংযোগ নিয়ে তিনি যে রায় দিয়েছিলেন, তা নিছক সুপারিশ; আদেশ নয়। উচ্চ আদালতের সেই নমনীয়তা এখন পরিত্যক্ত। বর্তমান রায়ে সুপ্রিম কোর্ট ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে সুনির্দিষ্ট 'আদেশ' দিয়েছেন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করতে বলেছেন। বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় যেসব প্রশাসনিক সংস্থার ওপর প্রযোজ্য তাদের সবাইকে ওই কমিটির নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিতে হবে অথবা খোদ মন্ত্রিসভায় যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে_ মাত্র ৩০ দিন। রায় বাস্তবায়নে অন্যথা হলে 'বিজ্ঞ এমিকাস কিউরিকে আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়েরের স্বাধীনতা' দেওয়া হয়েছে।
স্বাভাবিক ক্ষেত্রে একটি প্রকল্প নির্দিষ্ট কিছু পর্যায় ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে প্রকল্প তৈরি; বিভিন্ন দিক থেকে উপযুক্ত সংস্থা, কমিটি ও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা; পরিবেশ সুরক্ষা আইন, বনভূমি সুরক্ষা আইনের আওতায় বিধিগত অনাপত্তি; জাতীয় পুনর্বাসন নীতির বিধিনিষেধ অনুসরণ; জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কাছে প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা এবং সর্বশেষ মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত। সুপ্রিম কোর্ট এ সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সরকারকে দ্রুত বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ নয়, বরং এক লাফে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রস্তাবিত বিশেষ কমিটি ও মন্ত্রিসভা কি স্বাধীনভাবে প্রকল্পটি পরীক্ষা করে এই উপসংহারে পৌছতে পারবে যে, এটা অগ্রহণযোগ্য এবং অতি অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত? না, তারা সুপ্রিম কোর্টের আদেশমতো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাধ্য এবং তা করতে ব্যর্থ হলে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা এখন সরকারের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাতে অর্পণ করা হয়েছে; অবস্থান খর্ব করে সরকার ও পরিকল্পনা কমিশনকে সুপ্রিম কোর্টের অধীন ও আদেশ বাস্তবায়ন দফতরে পরিণত করা হয়েছে।
বিজ্ঞ বিচারপতিগণ কেবল একটি অনুমোদিত প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকতেন এবং তা দ্রুত করার আদেশ দিতেন। তাও সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পক্ষে যুক্তি দেওয়া যেত। বস্তুত 'আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প' নামে অনুমোদিত ও বরাদ্দপ্রাপ্ত কোনো প্রকল্পের অস্তিত্বই নেই। ২০০৩ সালে যখন এই ধারণা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছিল, এর সমর্থকদের গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ছিল যে, এটি কোনো প্রকল্প নয়, বরং মহাপরিকল্পনা মাত্র। এতে যে ৩০টি সংযোগ থাকবে, তার প্রত্যেকটি আলাদা প্রকল্প হবে এবং স্বাভাবিক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হবে। বলা হয়েছিল, সমালোচকরা অযথাই দৈত্যকায় প্রকল্পের জুজু দেখাচ্ছে। যেহেতু এটা 'ধারণা' মাত্র; কীভাবে 'বাস্তবায়ন' সম্ভব? বলা হয়েছিল, এই ধারণা প্রথমে প্রকল্পে রূপ নেবে, এর প্রত্যেকটি প্রকল্প উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় অনুমোদন বা বাতিল হবে, যেমনটি হয়ে থাকে। তারপর না আমরা বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলতে পারি।
ওই ৩০ প্রকল্পের কয়টি প্রকৃতপক্ষে অনুমোদিত হয়েছে? কোনোটিই নয়। কেবল তিনটি প্রকল্প_ কেন-বেতওয়া, দামানগঙ্গা-পিনজাল, পার-টাপি-নর্মদা বিস্তারিত প্রকল্প প্রতিবেদনের পর্যায়ে পেঁৗছেছে এবং আরএলপির আওাতভুক্ত একটিমাত্র প্রকল্প আলাদাভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার অন্যভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সেটাও বিতর্কে জর্জরিত। সত্যিকার অর্থে কোনো একটি প্রকল্পও বরাদ্দপ্রাপ্ত এবং বাস্তবায়ন উপযোগী নয়।
বিজ্ঞ বিচারকরা বলতে পারেন যে, তারা উদ্বিগ্ন। কারণ বর্তমান সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি এতটা অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল; ২০০২ সালে ঘোষিত একটি উত্তম প্রকল্প বা ধারণা বিলম্বিত হচ্ছে; নির্বাহী বিভাগের উদ্যোগহীনতার কারণে বিচার বিভাগকে পদক্ষেপ নিতে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি করতে হয়েছে। বস্তুত এই 'বিলম্ব' নির্বাহী বিভাগের ব্যর্থতা বা অদক্ষতার কারণে নয়; বরং জেনেশুনেই এ ব্যাপারে সরকার অঘোষিত 'ধীরে চলো' নীতি গ্রহণ করেছে। এনডিএ সরকার ২০০২ সালে এই প্রকল্প গ্রহণ করেছিল সমর্থকদের উজ্জীবিত করে ভোটের বাজারে সুবিধা পেতে। ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসা ইউপিএ সরকারে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ ছিল না, আবার একই সঙ্গে পরিত্যক্তও ঘোষণা করতে চায়নি। জোটের নূ্যনতম অভিন্ন কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল, প্রকল্পটি সমন্বিতভাবে এবং সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা হবে। এমন অবস্থান স্পষ্টতই প্রকল্পটির ব্যাপারে সরকারের দ্বিধার প্রমাণ। এই পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি হয়ে পড়েছিল পাল ছেঁড়া জাহাজের মতো। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রকল্পটির ব্যাপারে সরকারের মনোভাব সাধারণ মানুষ বা সুপ্রিম কোর্টের কাছে স্পষ্ট ছিল না।
আসলে সুপ্রিম কোর্টেরই উচিত ছিল সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাওয়া যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কী? তারা কি দেশের প্রয়োজনে এই প্রকল্পকে উত্তম অথবা একমাত্র সমাধান বলে মনে করে? যদি তাই হয়, তারা কি এ নিয়ে অগ্রসর হতে চায়; অথবা বিকল্প কিছু রয়েছে? যদি থাকে, সরকার কি এই ধারণা পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে? যদি নিয়ে থাকে, তার ভিত্তি কী? তা না করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের মোটেই উচিত হয়নি।

ড. রামাস্বামী আর আয়ার : ভারতীয় পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ; সাবেক পানিসম্পদ সচিব ও জাতীয় পানিনীতির প্রণেতা। শুক্রবারের হিন্দু থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর শেখ রোকন

No comments

Powered by Blogger.