এই দিনে-বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর by ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল

ব্রিটিশ আমলে প্রায়ই দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাব দেখা দিত। সেই প্রেক্ষাপট মনে রেখে জাতীয় খাদ্য ও কৃষি কমিশন এবং শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষ্য ছিল, ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য কৃষির সব বিষয়ে মৌলিক ও প্রায়োগিক শিক্ষা দান করে দক্ষ


কৃষিবিদ তৈরি করা এবং আধুনিক প্রযুক্তি কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারিত করে ফসল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মৎস্য উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি করা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং প্রধান খাদ্য চালের সঙ্গে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু সেদিন কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা দানের ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। এটা ছিল উচ্চতর কৃষিশিক্ষার জন্য এক দারুণ প্রণোদনা।
আজ ১৮ আগস্ট এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। পথিকৃৎ এ বিশ্ববিদ্যালয় এ পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার স্নাতক, ১৩ হাজার মাস্টার্স ও ৪০০ পিএইচডি তৈরি করেছে। কৃষিশিক্ষা ও গবেষণা বেশ ব্যয়বহুল। কিন্তু অর্ধশতকের এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতির প্রাপ্তিও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় দেশের মোট প্রায় সোয়া দুই কোটি একর আবাদি জমি কমতে কমতে সাম্প্রতিক কালে এক কোটি ৮৮ লাখ একরে দাঁড়িয়েছে। তবু সে সময় যেখানে মোট চাল উৎপাদন হতো ৮০ লাখ টনের মতো, তা বর্তমান সময়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার গুণ। এটা সম্ভব হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের খেতে-খামারে ও ল্যাবরেটরিতে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময়ের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা এখন দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ করে মানুষ বাড়ছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার প্রাক্কালে মাথাপিছু বছরে যেখানে মাত্র ১২০ কেজি চাল উৎপাদিত হতো, তা এখন বেড়ে ২২০ কেজি হয়েছে। হ্রাসকৃত জমি থেকে এই ক্রমবর্ধমান হারে চাল উৎপাদন করে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য জোগান দেওয়া হচ্ছে—এর প্রধান কৃতিত্ব গ্র্যাজুয়েটদের। কেবল চাল কেন, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি যেখানে তরল দুধের উৎপাদন ছিল মাত্র ৫ লাখ টনের মতো, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ টনে। ওই সময়ে ডিম উৎপাদিত হতো মাত্র ১৩ লাখের মতো, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭৪ কোটিতে। এটাও সম্ভব হয়েছে ভেটেরিনারি ও পশুপালন অনুষদ থেকে উত্তীর্ণ গ্র্যাজুয়েটদের অব্যাহত প্রচেষ্টায়। মাছ উৎপাদন? সত্তরের গোড়ার দিকে মাত্র সোয়া আট লাখ টন মাছ উৎপাদিত হতো, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ টনে। এটাও মাৎস্যবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েটদের অবদান। কৃষিপণ্যের এই অভূতপূর্ব উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন কৃষি প্রকৌশল গ্র্যাজুয়েটরা, যাঁরা কৃষি যন্ত্রপাতি ও সেচপ্রযুক্তিতে অবদান রেখেছেন এবং কৃষি অর্থনীতি গ্র্যাজুয়েটরা, যাঁরা কৃষি উৎপাদনের অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি, বিপণন ও কৃষিঋণ সরবরাহ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
এ বিশ্ববিদ্যালয় অধিকতর ফলনশীল ফসল, ফলমূল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মাছের জাত উদ্ভাবন করে সম্প্রসারণ বিভাগের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। উফশী ফসলের পর এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাইব্রিড, বায়োটেকনোলজি, ফসল ও প্রাণীর রোগব্যাধি নির্ণয় ও নিরাময়, পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রভৃতি নিয়ে গবেষণা চলছে। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিচিত্র ফলমূলসমৃদ্ধ সর্ববৃহৎ জার্ম প্লাজম সেন্টার ও নান্দনিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুবৃহৎ বোটানিক্যাল গার্ডেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এই দীর্ঘ সময়ে নতুন নতুন আরও যেসব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোতে শিক্ষক ও গবেষক সরবরাহ করে শিক্ষাকার্যক্রম চালু করতে অবদান রেখেছে।
মুক্তিযুদ্ধেই বা বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কম কিসে? বিপুলসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯ জন সম্মুখসমরে শহীদ হন।
ছাত্রছাত্রীদের থিসিস ছাড়াও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক হাজার গবেষণা প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে এবং উদ্ভাবিত হয়েছে অসংখ্য লাভজনক কৃষিপ্রযুক্তি। এক হাজার ২০০ একর এলাকার এই বিশাল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলছে প্রাগসর শিক্ষা ও গবেষণার কার্যক্রম নিয়ে খাদ্যনিরাপত্তার লক্ষ্যে। সংগত কারণেই সুবর্ণজয়ন্তীর স্ল্লোগান হচ্ছে, ‘খাদ্যেই শক্তি, কৃষিতেই মুক্তি’। আমার এ বিশ্ববিদ্যালয়টি উত্তরোত্তর আরও সমৃদ্ধ হোক।
ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল
সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। সদস্য, পরিকল্পনা কমিশন (কৃষি)।

No comments

Powered by Blogger.