সরল গরল-যে গল্পের শুরু আছে, শেষ নেই by মিজানুর রহমান খান

প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারা দিয়ে এই গল্পের শুরু। আর তখনই আওয়ামী লীগের অপছন্দের এক বিচারপতি ছিলেন মুখ্য চরিত্র। কে এম হাসান। যাঁর জন্য এল চতুর্দশ সংশোধনী, বাড়ল বিচারকদের বয়সসীমা। সেই সুবিধা যদিও এখন সবাই পাচ্ছেন, শুধু নিন্দার কাঁটা বিঁধল তাঁরই।


তিনি হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক ছিলেন। আওয়ামী লীগ তাঁকে টপকায়। ২০০১ সালের মে মাসে বিচারপতি রুহুল আমিন ও বিচারপতি ফজলুল করিমকে আপিল বিভাগে নেওয়া হলো। এর প্রতিবাদ জানান বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। তাঁদের শপথগ্রহণের আগে জাজেজ লাউঞ্জের সামনে অনেক আইনজীবীকে শায়িত অবস্থায় দেখা গেল।
সেই ঘটনায় মামলা হলো। থানায় মামলা করেন আওয়ামীপন্থী আইনজীবী ইরাজুল সাগর। তিনি নুরুল ইসলাম সুজনের ভাস্তে-জামাই। বর্তমানে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, তবে বিচারপতি পদপ্রার্থী। সুজন দুবার দলের টিকিট পান। প্রথমে হন বারের সেক্রেটারি, পরে সাংসদ। সমালোচকেরা বলেন, বার পলিটিক্সই তাঁর ভাগ্য খুলেছে।
ওই মামলার প্রধান আসামি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। ১৬ আসামির মধ্যে মোরশেদ খানও ছিলেন। সেদিন তাঁর মামলার তারিখ ছিল। কিন্তু এত বড় একটা ঘটনা হাতছাড়া করেননি। ওই মামলার অপর তিন আসামিকে জোট সরকার বিচারপতি করে। এর মধ্যে জাল সনদে বিতর্কিত ফয়জী ও বাদ পড়া আবদুস সালাম মামুন আছেন। কেউ কেউ সহকারী বা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে পুরস্কৃত হন। ওই মামলার পরপরই তা রিটে চ্যালেঞ্জ করা হয়। জননিরাপত্তা আইনে দায়ের করা ওই মামলায় আসামিদের প্রতিকার ও তা খারিজ করেন কে? ধিকৃত হয়ে বিদায় নেওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ। তাঁর নিয়োগকে অবৈধ হিসেবে রায় দেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
আমরা দেখব, আদালতের শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনার পক্ষ-বিপক্ষের চরিত্রগুলো কী করে বিচারালয়ে, অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে কিংবা মন্ত্রিত্বের মতো পদগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি যে, সুপ্রিম কোর্টে ভাঙচুর, মারামারি বা গোলমাল পাকানো ক্রমশ একটা প্রশ্রয়ধর্মী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবশেষ আপসের ধারায় আদালতে শর্তসাপেক্ষ দুঃখ প্রকাশের নজির স্থাপিত হয়েছে। এটা রুল অব লয়ের শর্ত পূরণ করবে না।
সুপ্রিম কোর্টের ২ আগস্টের ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়েছে। বিচার প্রশাসন নীরব। গোড়াতে দরজায় লাথি মারার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, সেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের আইন ছোঁয়নি। কারও শাস্তি হয়নি। কাউকে ক্ষণিকের জন্যও জেলে যেতে হয়নি। বরং জোট সরকার অতীতের সব রেকর্ড গুঁড়িয়ে স্রেফ কোটারি স্বার্থে নির্বিচারে বিচারক নিয়োগ প্রদান শুরু করেছিল। ‘প্রলয়’ এনেছিল। তারা কে এম হাসানকে টপকানোর শোধ নেয়। আগের দুজনকে টপকিয়ে তাঁকে করা হয় প্রধান বিচারপতি।
এরপর ২০০৪ সালে বিচারকদের বয়স বাড়ানো হলো। প্রতিবাদে আওয়ামী আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে সভা-সমাবেশ করেন। দিনে দিনে সুপ্রিম কোর্ট ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ বেড়েই চলেছিল। ১৯ বিচারকের নিয়োগের পরে আওয়ামী-সমর্থিত সুপ্রিম কোর্ট বার কড়া কড়া রেজুলেশন নিল। সেসব পড়ে আপনি ভাববেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এমন দরদি বন্ধু আর কে আছে। তারা প্রতি বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করত।
তো, একদিন বিচারপতি এম এ মতিন সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সভা-সমাবেশের বাড়বাড়ন্ত দেখে একটি আদেশ দিলেন। এর সারকথা হলো, সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে কোনো দলবাজি চলবে না। মিটিং-মিছিল চলবে না। সুয়োমোটো রুল। বিএনপির হাসি আর ধরে না। এখন যেভাবে আওয়ামী সমর্থকদের দিন, তখন ছিল বিএনপির দিন।
ওই রায়টি আমাদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকেই মানতে পারলেন না। তাঁরা রায়ের কপি পোড়ালেন। তখন কেউ কেউ আবিষ্কার করেছিলেন যে বিচারপতি এম এ মতিন বিএনপির লোক। প্রতিবাদে তাঁরা মুখে কালো কাপড় বেঁধেছিলেন। প্রধান বিচারপতির পদে বিচারপতি এম এ মতিনকে অন্যায্যভাবে টপকানো হলেও তাঁকে সরকার সম্প্র্রতি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান করে। সেদিনের কালো কাপড়ধারী নেতারা এখন উঁচু উঁচু স্থানে আছেন।
ওই সময়ে বাংলাদেশের মানুষকে আওয়ামী-সমর্থিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছিল যে স্রেফ দলীয় ভিত্তিতে যাঁদের বিচারক করা হয়েছে, তাঁদের বিষয়ে তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। এখন তারা সেসব রেজুলেশন ভুলেও স্মরণে আনে না।
৩০ নভেম্বর ২০০৬ সালে আসি। এদিন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির ইতিহাসের কলঙ্কিত আদেশটি দিলেন। সেটা বেগম খালেদা জিয়ার ফরমায়েশি বলে আওয়ামী লীগের নেতারা যে ধারণা জনগণকে দিয়েছিলেন, তা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষাও অহিংস থাকেনি। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। প্রধান বিচারপতির খাসকামরা তছনছ হলো। প্রথমে দুটি জিডি হলো। পরে রাষ্ট্রদ্রোহের জোড়া মামলা হলো। একটির বাদী ছিলেন ওমর সাদত, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের জামাতা। অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরও ভাঙচুর হয়েছিল। সেখানেও একটি মামলা হলো।
এসব মামলার আসামিদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরাও ছিলেন। তাঁদের কেউ ভাঙচুরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। কিন্তু ভাঙচুর যে হয়েছিল, সেটা অসত্য নয়। আগুনে গাড়ি পুড়েছিল, সেটাও সত্য। অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের দরজা-জানালা ভাঙা হয়েছিল, সেটাও সত্য। হাইকোর্টের আদেশদান মুহূর্তে সেদিন হাতাহাতি না হলেও হইচই-হুলুস্থুল হয়েছিল। আজকে আমরা দেখি, মামলাবহির্ভূত পক্ষকে না শুনে শুধু যেন তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ এল। হাতাহাতি হলো। অথচ এই আদেশে ‘সংক্ষুব্ধ’ হয়ে তাঁদের আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা। এই যুক্তি সেদিনও ছিল। মানা হয়নি। ‘ব্যক্তিগত’ কৈফিয়ত জানতে প্রধান বিচারপতির দপ্তরে ছুটে যান অনেকেই। এবং তাঁরা সেখানে ভাঙচুর করেন। এর প্রতিবাদে বিচারকেরা বিশ্ব ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম ধর্মঘট পালন করেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটি অবিশ্বাস্য ‘সত্য’ উপহার দিয়েছে। তারা বলেছে, কোনো আইনজীবী সেদিনের উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িত নন।
এবারে শুনুন, ওই ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দুটির কী হয়েছিল। ওমর সাদতের মামলার চার্জশিট হয়েছিল ১৫ দিনের মধ্যে। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ হলে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ প্রথমে রুল ও স্টে দেন। পরে বিচারপতি শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ মামলা খারিজ করেন। তাঁরা দুজন সম্প্রতি আপিল বিভাগে উন্নীত হয়েছেন। অভিযুক্তরা আগাম জামিন পেতে বেগ পাননি। এবারে বেগ পেতে হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের মামলায় আওয়ামীপন্থী আইনজীবী শেখ আওসাফুর রহমান একজন অভিযুক্ত। ১৬ জুলাই ২০০৮ আওয়ামী সরকারের আমলেই রাষ্ট্রদ্রোহের ওই মামলায় দুজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়। একজন গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী, অন্যজন তিনি। তখন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ছিলেন এ এন এম বশিরউল্লাহ (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক)। বাদী সুপ্রিম কোর্ট প্রতিনিধি। তিনি আদালতে বলেছেন, ‘আমি অফিসে কাজ করছিলাম। কিছু দেখিনি, জানিও না। প্রধান বিচারপতির আদেশে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করি।’
বিএনপিপন্থী আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও ব্যারিস্টার অসীম কুমার ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাক্ষী। তাঁরা আদালতে বলেন, ‘আমরা কিচ্ছু দেখিনি। ঘটনাস্থলে ছিলামই না।’ সুতরাং মামলা খালাস।
আদালত ও আদালত অঙ্গনে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনায় একাধিক আদালত অবমাননার রুল এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। আদালতে রায় দিতে বাধা দেওয়া, বিচারককে তিরস্কার করা, আদালত অবমাননার রুলে হাজিরার নির্দেশ অগ্রাহ্য করার ঘটনাও আছে। ৩০ নভেম্বরের ঘটনায় অভিযুক্তদের কেউ কেউ বিচারক হয়েছেন। তবে আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে শেখ আওসাফুর রহমানের গল্প চিত্তাকর্ষক।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তাঁর বিরুদ্ধে একটি আদালত অবমাননার রুল জারি করেছিলেন। তাঁর শর্ত ছিল পুনঃ আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তিনি ‘এই বেঞ্চে’ ওকালতি করতে পারবেন না। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেটা তাঁর নিজের ভাষায় এ রকম।
‘৩০ নভেম্বর ২০০৬। আমি আদালতে ছিলাম। একটু আগেই প্রধান বিচারপতির কক্ষ তছনছ হয়েছে। আমি তা দেখতে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে খবর পেলাম, মাননীয় বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি ছিলেন একটি একক বেঞ্চে। আমার গায়ে কালো গাউন ছিল না। আমাকে একজন বললেন, আপনাকে জজ সাহেব ডাকছেন। আমি সেখানে যাই। তাঁকে ঘটনার বিবরণ দিই। তবে সেই সঙ্গে আগ বাড়িয়ে বলি, অন্যান্য এজলাস থেকে মাননীয় বিচারপতিরা নেমে গেছেন। আপনিও নেমে আসুন।’ এ কথা শুনে তিনি হাসছিলেন। আমি বললাম, আপনি হাসছেন? এই হাসি আমাদের আগামী দিনের কান্নার কারণ হবে। এর চার দিন পর দিনকাল ও নয়া দিগন্ত পত্রিকায় খবর ছাপা হয়। ‘আমি তাঁকে গালাগালি করেছি। দাঁত খুলে নিতে চেয়েছি।’ এই খবর উল্লিখিত রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ক্ষুব্ধ আদালত রুল দেন। সমঝোতা দেখুন। ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট যাঁকে সাক্ষ্য মানেন। হাওয়া বদলের পর তিনিই আদালতে একই সহযোগীর প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ হন।
এবারে আইনের বাস্তব প্রয়োগ শুনুন শেখ আওসাফের জবানিতেই। ‘ওই রুলের পর আমি শুধু সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে মামলা করতাম না। একদিন আমি বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানি করতে যাই। তিনি আমাকে বলেন যে, আপনি তো এই আদালতে প্র্যাকটিস করতে পারেন না। তিনি আমার মামলা কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। আর একদিন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের বেঞ্চে একটি মামলা পরিচালনা করি। পরে তাঁর বেঞ্চে কনিষ্ঠ হিসেবে আসেন আদেশদানকারী বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। এরপর সেখানে গেলে বিচারপতি নাঈম আমাকে বলেন, আমরা আপনার মামলা শুনতে পারি না। মামলা সুরাহা করে আসুন। সেই মামলা যথারীতি বিচারাধীন। তবে আদালত অবমাননার মূল রুলদানকারী জ্যেষ্ঠ বিচারকের বেঞ্চেও এখন আমি যথারীতি মামলা পরিচালনা করছি।’
সুব্রত চৌধুরী ও শেখ আওসাফ একমত যে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিই আদালত অঙ্গনের জন্য কাল হয়েছে। তাঁরা বিচারপতি এম এ মতিনের রায় বাস্তবায়নই যে প্রতিষেধক, তা তাঁরা স্বীকার করেন। তবে বাস্তবতা হলো, এতে কারও বিশ্বাস নেই। মূল সংস্কৃতিটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না-রাখার মতো। সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বললেন, বিচারপতি মতিনের রায় এখন কার্যকর করতে চাইলে আমরা মেনে নেব না। তাহলে কি এভাবেই চলবে? আজকের অভিযুক্তরা আগামী দিনের বিচারপতি। আমরা এই চক্র থেকে রেহাই পাব না? সভাপতি মহোদয়ের অভয়বাণী: ‘আপনি লিখে যান। নেত্রীর (বিরোধী দলের নেতা) সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বিচার বিভাগে আর হস্তক্ষেপ হবে না। আমরা ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক করে ফেলব।’
আমাদের মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন, কারণ তা অরণ্যে রোদন। এই গল্পের যেন শুরুই আছে শেষ নেই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.