নদী বয়ে যাক

বাংলার ঐতিহ্য নদী মরে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশাল আধারই শুধু নয়, আমাদের কৃষিপ্রধান উৎপাদনব্যবস্থাও অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাচ্ছে এ কারণে। ৩৭৫টি নদীর মধ্যে ১৭৫টিই এখন শোচনীয় পর্যায়ে আছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। ভাবতে অবাক লাগে, যে দেশের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমেই বলা হতো নদীর কথা,


যে দেশটিকে বলা হতো নদীমাতৃক দেশ, সেই নদীমাতৃক দেশেই কি না অনেক নদী শুকিয়ে গিয়ে মরুভূমির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই সর্বনাশা ধ্বংসের পথ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে_এমন প্রশ্ন পরিবেশবিদদের প্রায় সবাই করছেন। আরো প্রশ্ন হচ্ছে, নদীগুলোর অবস্থা কেন এমন হচ্ছে? কে দায়ী নদী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য? জবাব দিতে কোনো বিশেষজ্ঞের মত প্রয়োজন হয় না। অত্যন্ত স্পষ্ট জবাব, মানুষই মানুষের সর্বনাশটি করছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন করছে মানুষ। এর প্রভাব পড়ছে নদীগুলোতে। এই যে নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে, এটাও তো মানুষেরই কারণে। নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। ব্যবহারের উপযোগিতা হারাতে হারাতে এখন এ পানিই মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ তো গেল ক্ষয়িষ্ণু নদীর একটি দিক। অন্য দিক হচ্ছে, নাব্যতা হারাতে হারাতে নদী আর সমতল এক হয়ে যাওয়া। পলি পড়তে পড়তে নদী তার নিজের রূপই বদলে ফেলছে। অথবা বলা যায়, মানুষই সেই সমতলে নদীকে পেঁৗছে দিচ্ছে। পাহাড় কেটে নদীর বুকে ঠেলে দিচ্ছে মাটি; সেই মাটি ধারণ করছে নদী। একসময় নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে পাহাড় আর সমতলের মানুষের অত্যাচারের কারণে। এভাবে বিলীন হয়ে গেছে দেশের ১৭টি নদী। এর বাইরে শুধু ঢাকা শহরেরই ১৮টি নদীর চিহ্নও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে চারটি নদী আছে ঢাকার চারদিকে, সেগুলো এখন যেন মৃত্যুকূপ। মানুষ এগুলোকে যেন ভোগদখলের বস্তুর মতোই মনে করছে। দুই পাড়ে বাড়িঘর, কারখানা বানিয়ে দখল করছে তো করছেই। ফলে নদীগুলোর প্রস্থ কমছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে শহরের বর্জ্য পড়তে পড়তে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, শুধু বুড়িগঙ্গা নদীর বুকেই নাকি ১০ ফুট পুরু পলিথিনের স্তর পড়েছে। এই তথ্য বলে দেয়, বুড়িগঙ্গা কী অবস্থায় বেঁচে আছে আমাদের মাঝে। ঢাকার হাজারীবাগ ট্যানারি থেকে যে বর্জ্য পড়ছে বুড়িগঙ্গায়, সেই বর্জ্য ধারণ করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে এই নদী। এখনো মানুষ সেখানে বর্জ্য ফেলে। আবার সেখান থেকে পানি এনে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতেও চাইছে। এই দ্বৈত অবস্থা নদীকে যেন আরো কাহিল করে ফেলছে। দুদিকের চাপ সহ্য করতে না পেরে বুড়িগঙ্গা এখন নাজেহাল। নদীর যদি মুখ থাকত, তাহলে তার পক্ষে বলা সম্ভব হতো মানুষের হাতে সে কতটা নির্যাতিত হচ্ছে।
এখনো সময় আছে, বাংলাদেশের নদীগুলোকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে। মানুষের অত্যাচারও কমাতে হবে। তা না হলে একদিন এমন সবুজ দেশটির জন্য আমাদের আফসোস করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.