চিকিৎসাব্যবস্থা-আরেকটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কেন প্রয়োজন by এ এম শামীম

চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক বিচরণের এক অবাধ ক্ষেত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়ায় হয়ে থাকে, যেমন সুইজারল্যান্ডের লিউস্যান ইউনিভার্সিটি, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়ার আইএমইউসহ আরও অনেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়।


কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নপরিক্রমা, অবকাঠামো, পারিপার্শ্বিকতা, সার্বিক কর্মকাণ্ড সবকিছুর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। কলেজে অপেক্ষাকৃত ছোট্ট গণ্ডিতে সীমিত পরিসরে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বিস্তৃত, ব্যাপক জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান। পদ্ধতি ও কাঠামোগত দিক বিবেচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে যেমন বহুমুখী বিষয় নির্বাচনের সুযোগ আছে, তেমনি আছে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, গবেষণা ইত্যাদি নিয়মিত কার্যক্রম। চিকিৎসাপেশায় উচ্চতর ডিগ্রি তথা পোস্টগ্র্যাজুয়েশন, গবেষণা ইত্যাদি ব্যতিরেকে বর্তমানে খুব বেশি সফল হওয়া যায় না। তা ছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত যে নতুন নতুন গবেষণা আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটছে তার সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ করে দিতে পারে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে আরও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন জরুরি। এ ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে বিশ্বমানের চিকিৎসা পেশাজীবী তৈরির উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিবিএস প্রোগ্রামের পরে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম যেমন এমএস, এমফিল, এমডি ইত্যাদিও নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই করতে পারবে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সুবিধাগুলো আছে, যেমন গবেষণা কর্মসূচি, পৃথিবীর অন্য দেশের সমমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রযুক্তি বিনিময়ের সুবিধাগুলোর সঙ্গে এমবিবিএসের ছাত্ররা যুক্ত হতে পারবে। এতে তাদের জ্ঞান বাড়বে বৈ কমবে না। একই প্রতিষ্ঠানে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামগুলো থাকার ফলে এমবিবিএসের ছাত্ররা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়াশোনার সময়ই তাদের ক্যারিয়ার প্লানিং করতে পারবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে এফসিপিএস, এমফিল, এমএস ইত্যাদি উচ্চতর ডিগ্রিতে ভর্তির জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করাও সহজ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নত অবকাঠামো, শিক্ষকের মান, শিক্ষার উপকরণসহ সম্পূর্ণ পারিপার্শ্বিকতা ও প্রযুক্তিগত সুবিধাদির অন্যতম সুবিধাভোগী হবে এর ছাত্ররা। আর তারাই ভবিষ্যৎ জীবনে তাদের মেধার প্রতিফলন ঘটাবে সুচিকিৎসার মাধ্যমে। তবে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট নিম্নমানের ছাত্র ভর্তি, পরীক্ষায় পাসের ব্যাপারে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা খোঁজা—এসব কালো ছায়ার প্রভাবকে একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন থেকে যতটা সম্ভব রাজনীতিকীকরণ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।
ডাক্তার, শিক্ষক এবং বিশেষজ্ঞ—যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন, তাঁদের জন্য ইতিবাচক দিক হলো, বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, তাই তাঁরা নির্দিষ্ট বয়সসীমার আবর্তে বন্দী না থেকে বেশি সময় একই স্থানে স্থায়ীভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন। এর ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক বেড়ে যাবে, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে তাঁরা দীর্ঘদিন কাজ করতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে তাঁরা বিশ্বের নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হবেন। সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের গড়ে তুলে ছাত্রদেরও আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে পারবেন।
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটি হাসপাতালের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁরাই তাঁদের কর্মদক্ষতা দিয়ে হাসপাতালকে সচল রাখেন। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে কিছু নিয়মনীতির মাধ্যমে তাঁদের চাকরির নিয়মাবলিকে সমন্বয় করা যাবে, যা তাঁদের ক্যারিয়ার প্লানিংয়ের জন্য সহায়ক হবে। বিদ্যমান মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্তে যেসব কর্মচারী চাকরি হারানোর আশঙ্কা করছেন, তাঁদের জন্য ইতিবাচক বিষয়টি হলো—কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ২৫-৩০ শতাংশকে তাঁদের মতামত সাপেক্ষে নতুন নির্মিতব্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা যেতে পারে। এতে যাঁরা এখানে থাকবেন, তাঁদের কিছু ওপরের পদ খালি হবে, এতে ভবিষ্যতে অধস্তন কর্মকর্তারা পদোন্নতি পাবেন। অন্যদিকে নতুন হাসপাতালে যাঁরা স্থানান্তরিত হবেন, তাঁদেরও যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা অমূলক।
বিশ্বের খ্যাতনামা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সদের জন্য উচ্চতর ডিগ্রি, যেমন এমফিল, পিএইচডি ইত্যাদির ব্যবস্থা রয়েছে। এসব উচ্চতর ডিগ্রি চালু করার মাধ্যমে তাঁদের চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এতে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রিধারী নার্সরা বিভিন্ন গবেষণা কর্মসূচি, হাসপাতালের প্রশাসনসহ আরও অনেক জায়গায় কর্মরত থাকবেন। নার্সদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার প্লানিংয়ের সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা। এখানে তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে বহুমুখী সুযোগ আছে। তাই নার্সদের জন্য মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অভিশাপ না হয়ে বরং আশীর্বাদরূপেই আবির্ভূত হবে। একটি হাসপাতালের প্রাণশক্তি হলো নার্স। তাই বর্তমানে কর্মরত নার্সরা রূপান্তরিত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবেন।
সরকারের অনুদান, খরচ, বাজেট ইত্যাদির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় একটি উচ্চাভিলাষী অবদান রাখতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে একটি বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দিতে হয় সরকারকে, যা এই মুহূর্তে সরকারের জন্য একটি অর্থনৈতিক চাপ। কর্তাব্যক্তিদের যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে রোগীদের থেকে স্বল্প আয়, সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির অনুদান, বিভিন্ন গবেষণা কর্মসূচি থেকে আয় ইত্যাদি দিয়ে পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে আয়-ব্যয়ে সামঞ্জস্য আনাও সম্ভব। এতে বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের আয়ে হাসপাতালটি চালাতে পারলে নিজেদের ওপর দৃঢ়তা, স্বনির্ভরতা ও একাগ্রতা বেড়ে যাবে।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সর্বোচ্চ সুবিধা রোগীরাই ভোগ করবে। তাই সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে এটাই হোক আমাদের দৃঢ়প্রত্যয়।

 ডা. এ এম শামীম: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড গ্রুপ।

No comments

Powered by Blogger.