১০০তম সেঞ্চুরি-ঢাকাতেই সেই ইতিহাস by পবিত্র কুন্ডু

কেউ কেউ ভাবতে পারতেন, তিন অঙ্কের জাদুকরি সংখ্যাটি ছুঁয়ে তিনি বুনো উল্লাস করবেন। শূন্যে ভাসবে শরীর। মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়বেন হাওয়ায়। যে অদৃশ্য শক্তি তাঁকে এক বছর চার দিন ধরে শতরানের ক্ষুধায় ‘অন্ন’ জোগায়নি, বড় শত্রু হয়ে ২২ গজে বিছিয়ে রাখে কাঁটা, সেই শক্তিকে পরাভূত করতে পেরে একটা অট্টহাসি দেবেন।

কিন্তু তিনি শচীন টেন্ডুলকার আগের ৯৯টি সেঞ্চুরির উদ্যাপন যেমন করেছেন, শততম সেঞ্চুরিটিকেও তেমনি করেই বরণ করে নিলেন। নন-স্ট্রাইক প্রান্তে পৌঁছে হেলমেটটি খুললেন। তাতে চুমু খেলেন। অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজলেন বাবাকে।
কেননা, তিনি তো জানতেনই, এই যে ‘শত্রু’ এই যে বাধা, এ সেই ক্রিকেট-নিয়তি। নিয়তিই ঠিক করে রেখেছিল, ১২ মার্চ ২০১১ বিশ্বকাপের পর থেকে তাঁকে এতগুলো দিন সেঞ্চুরির উপবাস করতে হবে। সেই উপবাস ভঙ্গ হবে ঢাকায়, মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। এশিয়া কাপে কোনো এক শুক্রবারের বিকেলে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১২তম ওয়ানডে ম্যাচে পেয়ে যাবেন নিজের প্রথম সেঞ্চুরি, যা সবগুলো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে তাঁর ওয়ানডে সেঞ্চুরির চক্রকে করবে পূর্ণ। ঘটনাচক্রে যেটি তাঁর শততম সেঞ্চুরি। ১৩৫ বছরের ‘বুড়ো’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ৩৫১৯টি টেস্ট, ১১৮৮ ওয়ানডে ও ৬টি টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ৪৭১৩ সেঞ্চুরির সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রতীক্ষিত সেঞ্চুরি!
মুশফিকুর রহিমের আন্তরিক প্রার্থনা শুনল না, মাহমুদউল্লাহর হূদয়ের ইচ্ছাকেও পাত্তা দিল না টেন্ডুলকারের ব্যাট। গোটা বাংলাদেশ দলের কামনার বিপরীতে গিয়েই আলোয় এসে গেল সেঞ্চুরিটি। তার পরও মিরপুরের গ্যালারিতে দাঁড়ানো অযুত মুখের আলো-আঁধারিতে আলোই থাকল বেশি। নিজেদের দল ২৯০ রান পেরোতে পারবে কি না, তা নিয়ে ছিল উদ্বেগ, কিন্তু তাবত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ৭৬৬ জন সেঞ্চুরিয়ানের মধ্যে এই প্রথম একজনের ব্যাট থেকে আসা শত সেঞ্চুরির ‘অপার্থিব’ অর্জন দেখার গৌরবময় অনুভূতিও সঙ্গী।
নিল আর্মস্ট্রংয়ের মতো ক্রিকেটের ‘চাঁদে’ প্রথম পা ফেললেন টেন্ডুলকার। কিন্তু এডউইন অলড্রিনের মতো যিনি দ্বিতীয়বার পা ফেলতে পারেন, তাঁকে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কেন, দেখা যাচ্ছে না বহুদূরের পথেও। রিকি পন্টিং ৭১টি সেঞ্চুরি করে নিকটতম দূরত্বে। ব্যবধান মাত্র ২৯ সেঞ্চুরির, কিন্তু ক্রিকেটীয় বিচারে যা কোটি মাইলের। তা হলে কে সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি? উত্তরটা সময়ের হাতেই তোলা থাকবে, যে সময়ের হিসাব আপাতত কারও জানা নেই।
ক্রিকেটের চাঁদে পৌঁছে কেমন ছিল ‘আর্মস্ট্রংয়ের’ অনুভূতি? এত দিন গণমাধ্যমের সামনে আসেননি। কাল তাঁকে আসতেই হতো। তিনি এলেন, ভাষ্যকার রমিজ রাজার বাড়িয়ে ধরা মাইক্রোফোনের সামনে কথা বললেন, পরে অকুণ্ঠ বক্তা সাংবাদিকদের ভরা হাটে। ৩৯ বছরের শরীরটা ২২ গজে কাটাচ্ছে ২৩টি বছর, ক্লান্তির আঁকিবুঁকি আছে, কিন্তু কণ্ঠটা এখনো দৃপ্ত। সেই ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি দিয়ে শততম সেঞ্চুরির যাত্রা শুরুর সময়ে যেমন ছিল, সে রকমই, ‘আমি তো শততম সেঞ্চুরির লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করছিলাম না। মৌসুম শুরু হয়েছিল ভালোই, ভালো ব্যাট করছিলাম। কিন্তু ভাগ্য সহায় হচ্ছিল না। কতগুলো সেঞ্চুরি হলো, এটা কোনো ব্যাপার নয়। আমি মাঠে নামি মাথা নিচু করে, সর্বস্ব ঢেলে দিই দলের জন্য।’
তা হলে এই যে শততম সেঞ্চুরি নিয়ে গোটা পৃথিবীর মেতে ওঠা, তাঁকে একটুও ছোঁয়নি? টেন্ডুলকার হাসেন, ‘মিডিয়াই প্রথম এটা তুলেছে। কই, ৯৯ সেঞ্চুরি নিয়ে তো এমন হয়নি! অথচ যেখানেই যেতাম, এটি নিয়ে সবখানেই কথা শুনতে হতো। রেস্তোরাঁর লোকেরা, হোটেলের রুম সার্ভিসের কেউ, সবাই বলত।’ তাঁর মাথায় কখনো সেঞ্চুরি ঘোরে না, তবে কৌতুক করে বললেন, এটি তাঁর কাঁধ থেকে ৫০ কেজির এক বোঝা নামিয়ে দিয়েছে!
তা হলে ৫০ কেজি বোঝা নেমে যাওয়ায় আবার তিনি ফুরফুরে মানুষ! আবার তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে স্বপ্নবান ক্রিকেটার, যিনি বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে নতুন স্বপ্নের দিকে ছুটে চলবেন? অবসরের ভাবনায় এখনো আক্রান্ত নন? তবে সবাইকেই যেহেতু থামতে হয়, তিনিও একদিন থামবেন। কে জানে সেই দিনটি অনতিদূরেই কি না! তবে যেদিনই থামুন, তাঁর স্বপ্নের মধ্যে বাংলাদেশ থাকবে, ঢাকার শেরেবাংলা স্টেডিয়াম থাকবে; যেখানে শততম সেঞ্চুরির নতুন ইতিহাস লিখেও প্রাপ্তি পরাজয়ের বিষাদ!

No comments

Powered by Blogger.