শান্তিরক্ষা মিশন-দারফুরে জাবেলমুন মিশনের স্মৃতি by রাশিদা সুলতানা

২৯ মে পালিত হলো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা দিবস, এই দিনকে উপলক্ষ করে জাতিসংঘ মিশনের অভিজ্ঞতা কিছুটা ভাগাভাগি করতে চাই। আশির দশকের শেষ সময় থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ তার কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছে। এ পর্যন্ত বহুবার জাতিসংঘের সর্বোচ্চ ‘পুলিশ কন্ট্রিবিউটিং কান্ট্রি’র মর্যাদা পেয়েছে।

২০১০ সালের ১২ মে বাংলাদেশ পুলিশ প্রথম একটি নারী কনটিনজেন্ট জাতিসংঘ শান্তি মিশন হাইতিতে পাঠায়। বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। কারণ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় নারী পুলিশ কনটিনজেন্ট।
শান্তিরক্ষী হিসেবে জাতিসংঘ শান্তি মিশন দারফুরে আমি কাজ করেছি। গোলাগুলির শব্দ, সহকর্মীদের মৃত্যু ও অপহরণ, সরকারি সেনা ও বিদ্রোহীদের হাতে দারফুরের সাধারণ মানুষের মৃত্যু, বোমাবর্ষণ, খাদ্য ও পানির জন্য মানুষের হাহাকার, নতুন শান্তিচুক্তি, অসহযোগ, নতুন সংস্কৃতি, নতুন পরিচয় ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ ও নানা অভিজ্ঞতায় আমার সময় কেটেছে। ২০১০-এর ডিসেম্বরে জাতিসংঘসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার একটি দলের সঙ্গে দারফুরের অন্যতম প্রধান সংঘাত-বিক্ষুব্ধ এলাকা জাবেলমুনে যাই। এ অঞ্চলে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। এলাকাটি ছিল দারফুরের অন্যতম বিদ্রোহী দল জাস্টিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্টের (সংক্ষেপে জেম) সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। ২০১০ সালের মে মাসে সুদান সরকারের সেনাবাহিনীর আক্রমণে বিদ্রোহী দল জেমের জাবেলমুন ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে সব সময়ই সাংবাদিক অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষে জাবেলমুন এলাকায় যাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য ছিল।
১৯১৫ সালের পর দারফুরের সংঘাত মূলত চলে শক্তিশালী আরব শাসক দল এবং আফ্রিকার মূল জনগণ আফ্রিকান জাতিগোষ্ঠীর খুদে কৃষকদের সঙ্গে। বছরের পর বছর সম্পদের অধিকার ও নানা বৈষম্য নিয়ে এই সংঘাত চলতে থাকে। আশির দশকে এই সংঘাত তীব্র হয় এবং হাজারো লোক নিহত হয়। ২০০৩ সালে দারফুরে বিভিন্ন বিদ্রোহী দল সুদান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তখন সুদান সরকার আরব জাতিগোষ্ঠীর নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনী জানজাবিদদের দিয়ে এই বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে। এই সংঘাতে আড়াই লাখ মানুষ শরণার্থী হয় এবং নিহত হয় প্রায় দুই লাখ।
দারফুরের আলজেনেইনা থেকে জাবেলমুনে যেতে ইটের রাস্তা বলতে দু-তিন কিলোমিটার পথ, বাকি পুরোটাই মেঠোপথ। এর মধ্যে প্রবল ধুলা উড়িয়ে এগিয়ে চলে কনভয় প্রায় সর্বোচ্চ গতিতে। জাবেলমুন পর্বতমালার কাছাকাছি সেলিয়াতে একটি এনজিওর গেস্টহাউসে উঠি। প্রথম দিন আমরা হেজেলিজা আইডিপি ক্যাম্প এবং পার্শ্ববর্তী কিছু গ্রামে যাই। আমার দেশের বস্তির মতোই প্লাস্টিকে ও শনে ছাওয়া ছোট ছোট ঘরে এই আইডিপি ক্যাম্পসংলগ্ন ২৩টি গ্রামের মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ২০০৩ থেকে সংঘাতের বিভিন্ন সময়ে মানুষগুলো এখানে-সেখানে ছুটে বেড়িয়েছে। কখনো পার্শ্ববর্তী দেশ চাদের রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। খাদ্যাভাবের কারণে কখনো পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার জাবেলমুন পাহাড়ে ফিরে এসেছে। তবে যেসব গ্রাম থেকে তারা এসেছে, তাদের সেই সব আদি ঘরবাড়ি এবং গ্রামের বেশির ভাগই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
সাদা আলখাল্লা পরা, অপুষ্টিতে ভোগা দরিদ্র শেখ, উমদার তাদের নানা অভাব, কষ্টের কথা বলে। আরও বলে স্বজনদের মৃত্যুর কথা।, বারবার উন্মুল হয়ে যাওয়ার কথা। মৃত নয়, জীবিত মানুষগুলোর কারও কারও মুখ, শরীর ঢাকা থাকে মাছিতে। দীর্ঘদিন গোসল না করার কারণে এমন ঘটে। এরা কেউ কেউ এখানকার শেখ, উমদা।
দারফুরে নারীদের জীবন বড় সংগ্রামের। সারা দিন বৃক্ষছায়ায় শুয়ে-বসে আলস্যে দিন কাটিয়ে দেয় পুরুষেরা। অথবা দলবেঁধে কৌমের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুরুষেরা অধিকাংশই একাধিক স্ত্রীর ‘মালিক’। হাটে বেচাকিনি, জ্বালানি সংগ্রহ, দূর-দূরান্ত থেকে গাধার পিঠে চড়ে অথবা পায়ে হেঁটে পানি আনা, জ্বালানি সংগ্রহ, গেরস্থালির কাজ, সাত-আটজন সন্তান জন্মদান, লালন-পালন—এই সবই মেয়েদের কাজ। কাঁচা বাজারগুলোতেও শরিয়া আইনের দেশে ঘোমটা পরিহিত নারীরাই বিকিকিনি করে।
উপত্যকায় পথের দুই পাশে পুড়ে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া লরিগুলো প্রমাণ দেয় এখানে কী রকম লড়াই চলেছে। পথিমধ্যে সুদানি মিলিটারি আমাদের আটকে দেয় এবং জানায়, এই পথে উপত্যকার মধ্য দিয়ে আমাদের উদ্দিষ্ট গ্রামে যাওয়া যাবে না। বাইরে পাহাড়ের বহিঃরেখার মরুভূমি দিয়ে ঘুরপথে যেতে হবে জাবেলমুনের অভ্যন্তরে আল্লানা ও কুরকুরু গ্রামে। যে পথে আমরা এসেছিলাম, সেই পথে বের হয়ে পর্বতশ্রেণীর বহিঃরেখায় মরুপথে আমরা ছুটি। উপত্যকায় পাহাড়ি গ্রাম আল্লানায় আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন আমাদের অপেক্ষায় ছিল। মেয়েরা নানা বয়সী সন্তান কোলে নিয়ে আসে। শেখ-উমদা, নারী, যুবক—সবাই তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সুদানি পুলিশ ও মিলিটারি মাথার ওপর অস্ত্র নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। স্বল্প সময়ের জন্য আমাদের দল থেকে সুদানি মিলিটারি সরে গেলে জানা যায়, সরকারি বাহিনীর গোলাবর্ষণে আল্লানা গ্রামে দেড় শ বেসামরিক মানুষ মারা যায় সর্বশেষ সরকারি-বিদ্রোহী দলের সংঘাতে।
নারীরা জানায়, সরকারি সেনা ও বিদ্রোহীদের হাতে ধর্ষিত হওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়, এই তাদের জীবন ২০০৩-এ সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে। আবারও সঙ্গিন উঁচিয়ে মিলিটারি আমাদের মাথার ওপর দাঁড়ায়। গ্রামবাসীর কথা বলা তখন বন্ধ হয়ে যায়।
মাঝরাতে জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে মরুভূমির রাতের আকাশ দেখতে গেস্টহাউস (টুকল) থেকে বেরোতেই দেখি আকাশজুড়ে ফুটে আছে শত-সহস্র গ্রহ ও নক্ষত্র। এমন নক্ষত্রের রাত জীবনে কোনো দিন দেখিনি। আকাশ যেন শতগুণ নিচে নেমে এসেছে। পর পর কয়েকটা উল্কাপতন ঘটে, মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে ধূমকেতু, নক্ষত্রপুঞ্জে ঝড় উঠবে। মরুভূমির রাতের এমন সৌন্দর্যের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য তুলনীয় নয়।
জাবেলমুনের সর্বহারা মানুষের সঙ্গে তিন দিনের সময় কাটানোর আচ্ছন্নতার রেশ নিয়ে আলজেনেইনায় ফিরে আসি। সেখানে এখন শান্তি প্রতিষ্ঠার নানা উদ্যোগ চলছে। সর্বোচ্চসংখ্যক ‘ফর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন’ পাঠিয়ে শান্তির এই উদ্যোগে বাংলাদেশ রেখে চলেছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
রাশিদা সুলতানা: ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (চলতি দায়িত্বে)।

No comments

Powered by Blogger.