শুভকামনা-‘আমি বাংলাদেশের আজম খান’ by হানিফ সংকেত

এ দেশে ব্যান্ডসংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাঁদের মধ্যে অগ্রণী শিল্পী হচ্ছেন আজম খান। সেই সত্তরের দশকের শুরু থেকে সংগীত জগতে তাঁর অভিযাত্রা। সংগীতের বাইরেও এই মানুষটির বড় পরিচয়—একজন মুক্তিযোদ্ধা। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়।

সে সময় ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’র সদস্য হিসেবে গণসংগীতও গেয়েছেন। একাত্তর সালে যুদ্ধ শুরু হলে চলে যান আগরতলায়। সে সময় তাঁর গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাত। মুক্তিযুদ্ধে আজম খান সম্মুখযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। একাত্তর সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনি দেশে ফেরেন। এরপর নতুন উদ্যমে শুরু হয় আজম খানের সংগীতযুদ্ধ। সেই উচ্চারণ ব্যান্ড থেকে শুরু। বাহাত্তর সালে বিটিভিতে প্রচারিত ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে...’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে...’ এই গান দুটি আজম খানকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তারপর একে একে ‘সালেকা-মালেকা, হাইকোর্টের মাজারে, রেললাইনের ওই বস্তিতে’ তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। আজ তিনি পপসম্রাট। এত গুণের অধিকারী এই মানুষটির মধ্যে নেই অহংকার, অত্যন্ত সহজ-সরল, সাদা মনের নির্লোভ এক মানুষ। আশির দশকের শুরুতেও আজম খানের সঙ্গে আমার পরিচয় শুধু টিভির পর্দায়ই সীমাবদ্ধ ছিল। ‘ইত্যাদি’ যখন বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে বাইরে অর্থাৎ প্যাকেজ অনুষ্ঠান হিসেবে নির্মাণ শুরু করি, তখন আমার প্রিয় এই মানুষটিকে নিয়ে একটি গান করার তাগিদ অনুভব করি। সেই তাগিদে একদিন চলে যাই আজম ভাইয়ের বাসায়। পঁচানব্বই সালের গোড়ার দিকে ‘ইত্যাদি’তে আজম খানের বিখ্যাত গান ‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাব না...’ গানটি করলাম। সঙ্গে তাঁর সেই নিত্যদিনের কাজগুলো ধারণ করে একটি প্রতিবেদনও প্রচার করলাম। এরপর আজম ভাই যখনই কোনো নতুন অ্যালবাম করতেন, কিংবা তাঁর পছন্দের কোনো গান তৈরি হতো, তিনি আমাকে ফোন করতেন। বলতেন, এবার একটা নতুন গান করেছি। ফোন পেলেই আমি কাউকে পাঠাতাম কিংবা তিনি কাউকে দিয়ে গানটি পাঠিয়ে দিতেন। এভাবেই ‘ইত্যাদি’তে এবং আমার করা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আজম ভাইয়ের অনেক গান করার সৌভাগ্য হয়েছে।
গত বছরের জুলাই মাসে জানতে পারি, আজম ভাই দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত। তাঁর মুখগহ্বরে ক্যানসার ধরা পড়েছে। স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিতে হবে। প্রচুর টাকার দরকার। অনেকেই এগিয়ে এসেছেন তাঁদের ভালোবাসার এই মানুষটির সুচিকিৎসায় সহায়তা দিতে। জুলাইয়ের ১২ তারিখে গীতিকার ও সাংবাদিক কবির বকুল আমাকে ফোন করে জানালেন, ওই দিন বিকেল চারটার মধ্যে আজম ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকার দরকার। ফোন করল ব্যান্ডতারকা আইয়ুব বাচ্চুও। আজম ভাইয়ের জন্য যেই শিল্পীর বা প্রতিষ্ঠানের কাছেই অর্থ চেয়েছি, কেউ নিরাশ করেনি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজম ভাইয়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় হয়। ২১ জুলাই তাঁর মুখগহ্বরে জটিল অস্ত্রোপচার হয়। সিঙ্গাপুর যাওয়ার সময় আজম ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়, ‘দোয়া কইরেন, যাতে ভালোভাবে ফিরতে পারি। আইসাই কিন্তু “ইত্যাদি”তে একটা গান করুম।’ অপারেশন শেষে আজম খান অনেকটা সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন। ফিরে আসার পর তাঁর পছন্দের একটি গান পাঠালেন, যার প্রথম লাইনটি—‘আমি বাংলাদেশের আজম খান, বাংলাতে গাই পপ গান, জারি-সারি ভাটিয়ালি এক মায়ের সন্তান, আমি আজম খান...’। গানটি লিখেছেন মনি জামান, সুর করেছিলেন আবুল খায়ের। সে সময় আজম ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা ততটা ভালো যাচ্ছিল না। কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। অক্টোবরের ১০ তারিখ ধারণের দিন ঠিক করলাম। আজম ভাইয়ের মেয়ে ইমা খান বলল, ‘বাবা তো অনেক দুর্বল। কী করে গান করবেন বুঝতে পারছি না।’ আমি অভয় দিলাম। আজম খান নির্দিষ্ট সময়ে এলেন, সঙ্গে তাঁর মেয়ে ইমা খান ও অরণী। এসেই পরম আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। সে স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। একই লোকেশন হওয়ায় দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই গানটির ধারণ সম্পন্ন হয়। শুটিং শেষে বললেন, ‘সব ঠিক ছিল তো?’ গানটি প্রচারিত হয় ২৯ অক্টোবর ‘ইত্যাদি’তে। এটাই ছিল টেলিভিশনের পর্দায় এ পর্যন্ত করা আজম খানের শেষ গান। এই গানটি আজম ভাইয়ের কাছে এত বেশি প্রিয় হওয়ার একটিই কারণ—এটি ছিল একটি স্মৃতিচারণামূলক গান। যেখানে তাঁর করা কিছু জনপ্রিয় গানের চরিত্র স্থান পেয়েছিল। গানটি প্রচারিত হওয়ায় তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।
আজম খানকে নিয়ে ‘ইত্যাদি’তে ও বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার কারণে আমাদের কাছে তাঁর বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র রয়েছে। আজম খান যখন অসুস্থ হয়েছিলেন, সে সময় অনেকেই আমাদের কাছ থেকে এসব ভিডিও ফুটেজ নিয়েছেন এবং আমরাও আন্তরিকতার সঙ্গে তা দিয়েছি। এবার যখন তিনি অসুস্থ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অর্থাৎ লাইফ সাপোর্ট নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন এবং পরিবার থেকে তাঁর জন্য দোয়া চাওয়া হচ্ছে, ঠিক তখনই দু-একটি চ্যানেলের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ দেখে হতবাক হয়ে যাই। টেলিভিশনে হাজার হাজার দর্শক দেখেছেন, তাঁদের প্রিয় মানুষ আজম খানের মৃত্যুসংবাদ। খবরটি দেখে সবার মতো আমারও বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল। আজম ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু মতিন ভাইকে ফোন করে জানতে পারি, আজম ভাই এখনো আমাদের ছেড়ে যাননি। তবে তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। কিছু কিছু চ্যানেলে তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচারের কারণে পরিবারের সবাই ক্ষুব্ধ। তবে এ ধরনের ভুল সংবাদ পরিবেশনের জন্য কেউ দুঃখ প্রকাশ করেছে বলে শুনিনি।
২৯ মে সকাল ১০টায় স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে গিয়েছিলাম আজম ভাইকে দেখতে। একই সময় গিয়েছিলেন স্কয়ার টয়লেট্রিজের পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীও। আইসিইউর ১০ নম্বর বেডে শুয়ে আছেন আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর সেনা, ব্যান্ডসংগীতের জনক, বাংলাদেশের আজম খান। প্রার্থনা, ‘আসি আসি বলে তিনি আবারও ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে’। আমি অপেক্ষায় আছি আজম ভাইয়ের মুখে সেই কথাটি শোনার জন্য—এবারও আপনার জন্য একটি নতুন গান করেছি।
হানিফ সংকেত: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.