শিবের গীত-উপদেশ-কূপদেশ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

শওকত ওসমান একটি বই লিখেছিলেন উপদেশ-কূপদেশ নামে এবং এর পোস্তানিতে বড় বড় হরফে একটা ছড়া লিখে দিয়েছিলেন আমাকে, তাঁর স্বাক্ষরসহ, যেমন দিতেন প্রিয়জনদের: ‘উপদেশে ভাল হয় লোক, মন্দও হয়/ চিকিৎসায় ভাল হয় চোখ, অন্ধও হয়।’ ভালো উপদেশে দেশও ভালো চলে, মন্দ উপদেশে গোল্লায় যায়—না, গোল্লায় যাওয়া থেকেও আরও খারাপ যা, পাতকুয়ায় পড়ে কূপদেশ হয়ে যায়।

বাংলাদেশে বরাবর অনেক কিছুরই অভাব—চাকরি থেকে নিয়ে নিত্যপণ্যের, কিছু বিত্তবান ছাড়া প্রায় সবারই—শুধু অভাব নেই উপদেশের। সবাই আমরা সবাইকে উপদেশ দিই, নিজেরা সেই উপদেশ মেনে না চললেও। উপদেশ দেওয়ার জন্য এক কোটি লোক বসে আছেন নানা প্রতিষ্ঠানে-অপ্রতিষ্ঠানে, সরকারে-সরকারের বাইরে। টিভিতে সেদিন এক মনস্তত্ত্ববিদ উপদেশ দিলেন কীভাবে সহিংস পরিস্থিতিতে টিকে থাকা যায়। তাঁর সহজ উপদেশ, ‘সহিংসতা এড়িয়ে চলুন।’ উৎকৃষ্ট উপদেশ নিঃসন্দেহে—এড়িয়ে চলুন। আপনাকে তাক করে পাঁচ-ছয় বন্দুকধারীকে এগিয়ে আসতে দেখলেও। এ রকম অবস্থায় বন্দুকধারীদের আপনি বলবেন, ‘ভাই, আমি সহিংসতা এড়িয়ে চলছি, আমাকেও আপনারা এড়িয়ে চলুন।’ তবে তাতে একটা বিপদ। আপনাকে এড়িয়ে চলার উপদেশ দিলে আপনাকেই না সন্ত্রাস ভেবে বসে তারা? তারপর আপনার বাবাকেও? তবু, এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। মনস্তাত্ত্বিক শান্তি পাবেন।
টিভিতে আরেকটা মূল্যবান উপদেশ শুনলাম, এক চলাচল বিশেষজ্ঞ দিচ্ছেন, কীভাবে সহজে ঢাকার রাস্তায় চলবেন, সে বিষয়ে। তিনি বললেন, চলাচল করবেন ‘সামনে-পেছনে দেখে-শুনে’। কী দেখব অথবা কী শুনব, সে সম্পর্কে তিনি অবশ্য কিছু বলেননি। নিচের দিকে দেখতেও বলেননি। ঢাকার রাস্তায় দেখার ও শোনার এত কিছু আছে যে সবচেয়ে গোবেচারা জেব্রা ক্রসিংটার মুখে দাঁড়িয়ে এসবের একটা তালিকা করতে গেলে কাগজে কুলাবে না। আর যা সামনে-পেছনে দেখা যায় না, তার কী হবে? যেমন—আজ সকালে গজিয়ে ওঠা গাতাগর্ত, নতুন মুখ-ব্যাদান করা ম্যানহোল? তার পরও উপদেশ যেহেতু, মেনে চলার চেষ্টা করি। তাতে অবশ্য ম্যানহোলগুলোর সঙ্গে আমার জুতা-জামার সখ্যে কোনো চিড় ধরেনি।
এসব উপদেশ অবশ্য মন্দ না, অর্থাৎ এগুলো আপনাকে কূপদেশের নাগরিক বানাবে না, কূপসদৃশ ম্যানহোলে মাঝেমধ্যে পাঠিয়ে দিলেও। সমস্যা হচ্ছে মন্দ উপদেশ নিয়ে। সেগুলো নিয়ে আমরা কী করতে পারি? একটা যা করা যায়, নাসিরউদ্দিন হোজ্জাকে অনুসরণ করতে পারি। তিনি তাঁর দেশের রাজাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, মন্দ উপদেশে বিলকুল কান দেবেন না। হোজ্জা খুব প্রিয় ছিলেন শওকত ওসমানের। একদিন এক তরুণ লেখক দেশের একগাদা সমস্যা নিয়ে খেদোক্তি করার পর শওকত ওসমান তাকে বলেছিলেন, ‘ভ্রাতঃ, হোজ্জার কথা ধার করে বলি, আপনার সমস্যার সমাধান হচ্ছে জন্মের অতীতে চলে যাওয়া। টু বিকাম আনবর্ন।’ মরে যাওয়া নয়, জন্মের অতীতে চলে যাওয়া। এখনো জন্ম হয়নি, এ রকম মানুষের কোনো সমস্যা থাকে না—বন্দুকধারীরা তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না, তার আব্বাজানের মানসম্মান নিয়ে টানাটানিও করতে পারে না।
হোজ্জা একবার দীর্ঘ বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু তিন-চার দেশ দেখে অল্প দিনে ফিরে এলে প্রতিবেশীরা খুব অবাক হলেন। ‘কী ব্যাপার, হোজ্জা সাহেব!’ তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন। ‘সব দেশই তো প্রায় আমার দেশের মতো, দেখার কী আছে!’ তিনি বললেন। ‘সব দেশেই তো দেখি মানুষ খালি উপদেশ দেয়, দিয়ে আপনার বারোটা বাজায়।’ হোজ্জা নিশ্চয় একাধিক ম্যানহোলেও পড়েছিলেন। যা হোক, রাজা তাঁকে ডেকে পাঠালেন, ‘কী হোজ্জা, আমার দেশটা নাকি সব দেশের মতোই খারাপ?’ হোজ্জা জিভে কামড় দিয়ে বললেন, ‘সেকি কথা, রাজামশাই! সব দেশ খারাপ কেন হবে? একটা দেশ তো দেখেছি খুবই ভালো। যাকে বলে বেহতর।’ ‘আচ্ছা,’ রাজা বললেন, ‘তা কীভাবে সে দেশ আমার দেশ থেকে ভালো হয়?’ হোজ্জা রাজার পাশে লাইন ধরে বসা পরামর্শদাতা ও উপদেষ্টামণ্ডলীর দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘ওই দেশের রাজা নিজের বিবেক-বুদ্ধিমতো এবং মানুষের প্রত্যাশামতো দেশ চালান। একাই চালান। তাঁর কোনো পরামর্শ-উপদেশ প্রদায়ক বাহিনী নেই।’
এর পরও যে হোজ্জা বেঁচেবর্তে ছিলেন, তাতে রাজা যে তাঁর উপদেশ শুনেছিলেন, এ রকমই ধারণা ছিল শওকত ওসমানের।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.