জামিল ভাই, খুব কষ্ট! by মাহবুব হোসেন খান নবীন

মঙ্গলবার যাচ্ছিলাম মুন্সীগঞ্জে লঞ্চডুবির ছবি তুলতে। হঠাৎ আমার মোবাইল ফোনে এক সহকর্মীর কল এলো। ভাবলাম, ওই সহকর্মী হয়তো আসতে পারেনি, আমার কাছে ছবি চাইবে। কিন্তু না। কলটি ধরতেই গম্ভীর কণ্ঠটি বলল, নবীন, জামিল ভাই আর নেই। কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কষ্ট সইতে পারছিলাম না। তাই ফোনটি বন্ধ করে দিলাম।

আরও একটি কল এলো। এবার প্রশ্ন, লাশ কোথায়? কোথায় কোথায় জানাজা হবে? খুবই বিরক্তবোধ করলাম। আমার প্রিয় জামিল ভাইয়ের লাশের খবর আমাকে জিজ্ঞাসা করছে! হয়তো বিষয়টি অতি স্বাভাবিক, নিয়তির নিয়ম। তবে আমি এখনও ভাবতে কষ্ট পাই আমার জামিল ভাই নেই।
সংবাদে সাত বছর তার পরম স্নেহে ফটোসাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করেছি। একবার একটি বিড়ালকে বাঁচাতে গিয়ে আমরা দু'জনেই মরতে বসেছিলাম। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় এক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্ট থানায়। তার ছবি সংগ্রহ করতে আমরা দু'জনে থানায় গেলাম। থানা কর্তৃপক্ষ আমাদের ছবি তুলতে দিল না। নিরাশ হয়ে আমরা অফিসের উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে একটি বিড়ালকে বাঁচাতে গিয়ে জামিল ভাই তার ভেসপায় (তিনি একটি লক্কড়ঝক্কড় মার্কা ভেসপা বাইক চালাতেন) ব্রেক কষলেন। বিড়ালটি রক্ষা পেল, আমরা দু'জন আহত হলাম। অফিসে ঢুকতেই বার্তা সম্পাদক মনজুরুল আহসান বুলবুল ভাই বললেন, সংবাদে মাত্র দু'জন ফটোগ্রাফার, তাও যদি ঠ্যাং ভাঙা হয় তা হলে চলবে কী করে? আমি অফিসে গিয়েও জামিল ভাইকে বললাম, একটা বিড়ালের জন্য আমাদের দু'জনকেই তো মরতে হতো। বিড়ালটা মারা গেলে কী হতো? জামিল ভাই আমার গালের চামড়া টেনে ধরে বললেন, এই তুই জানিস না, আমি বিড়াল ভালোবাসি। জামিল ভাই বাসায় বিড়াল পালতেন। বিড়ালের প্রতি তার অনেক ভালোবাসা।
একজন অভিভাবক হিসেবে জামিল ভাইকে যে না পেয়েছেন, পেশা জীবনে অনেক কিছু থেকেই তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। জামিল ভাই সদালাপী, সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ ছিলেন। অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে কোনো জুনিয়র ফটোগ্রাফারের ভুল ফ্রেমে ছবি তোলা দেখলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের ছবি তোলা বন্ধ রেখে তাকে দেখিয়ে দিতেন, কীভাবে ফ্রেম করতে হবে।
একদিন সংবাদ থেকে রাতে জামিল ভাই আমাকে জোর করে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। আমার অন্য বাসায় ঘুম আসে না বলার পরও তিনি আমাকে এক প্রকার জোর করেই তার গোপীবাগের ভাড়া বাসায় নিয়ে গেলেন। তার বাসায় গিয়ে অনেক রাতেও যখন আমার ঘুম পাচ্ছিল না, তখন তাকে বলার পর জামিল ভাই আমাকে অপেক্ষা করো কথা বলে বিছানা ছেড়ে গিয়ে একটি সেতার বের করে নিয়ে এলেন। আমি বললাম, এটা আবার কী? এমনিতেই ঘুম আসে না আপনি আবার টুংটাং বের করলেন কেন? জামিল ভাই আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, তুই শুয়ে থাক, আমি সেতারটা বাজাই। কিছুক্ষণ পর জামিল ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কী নবীন চুপ কেন? আমি বললাম, ধুর বন্ধ করেন, আমি ঘুমাই। এক পর্যায়ে জামিল ভাইয়ের সেতারের সুরে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
কিছুদিন আগেও সমকালে আমার একটি ছবি ছাপা হওয়ার পর তিনি প্রশংসা করে কিছু নতুন কৌশল ও নির্দেশনা দিলেন। দেশ ও দশ কী হারাল আমি তা জানি না। তবে আমার কষ্ট, আমি আমার একজন অকৃত্রিম ভালোবাসার শিক্ষক, একজন অভিভাবককে হারালাম। যার আমৃত্যু ছাত্র থাকার সুপ্ত বাসনা ছিল আমার মনে।

মাহবুব হোসেন খান নবীন : চিফ ফটোসাংবাদিক, সমকাল

No comments

Powered by Blogger.