শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন-আলোর মশাল হাতে একদল তরুণ by সফি খান

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নাখারগঞ্জ। ভারতের সীমান্তবর্তী এই গ্রামে মাদক, জুয়া আর অশ্লীল নৃত্যের আসর ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। এই গ্রামকে আলোর পথে আনতে লড়াই শুরু করেছেন গ্রামেরই কয়েকজন তরুণ। তাঁদের হাত ধরে সেই লড়াই ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশেও। অন্ধকার দূর করতে প্রথমেই তাঁরা শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। শুরু করেছেন ঝরে পড়া শিশুদের বিনে পয়সায় পড়ানো। এর খরচ জোগাচ্ছেন নিজেদের টিউশনি থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে। গড়ে তুলেছেন ‘আশার আলো পাঠদান কেন্দ্র।’
শুরুর কথা: নাখারগঞ্জ গ্রামের অভাবী পরিবারের ছেলে বিশ্বজিৎ কুমার। ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে তিনিসহ কয়েকজন ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পড়তে শিক্ষকদের কাছে যান। কিন্তু তাঁদের বিনে পয়সায় পড়াতে কেউ রাজি হননি। টাকা দিয়ে পড়বেন, সেই অবস্থাও নেই কারও। বিষয়টি বিশ্বজিৎসহ তাঁর বন্ধুদের মনে দাগ কাটে। বন্ধুরা মিলে প্রতিজ্ঞা করেন, নিজেদের চেষ্টাতেই পড়াশোনা করবেন। কোনো পরিস্থিতিতেই পড়াশোনা বন্ধ করবেন না।
সবাই মোটামুটি ভালোভাবেই এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন স্থানীয় কলেজে। বিশ্বজিৎ একদিন জানতে পারেন, তাঁদের গ্রামে তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রীর বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হচ্ছে। বিশ্বজিৎ বন্ধুদের নিয়ে সেই বাড়িতে যান। ছাত্রীর বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। ওই ছাত্রীকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন তাঁরা।
এই বিষয়গুলো ভাবায় বিশ্বজিৎকে। একদিন কলেজ শেষে তিনি বন্ধুদের নিয়ে বসেন। দরিদ্র শিশুদের পড়াশোনার বাধাবিপত্তিগুলো তুলে ধরেন। এদের কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায়, তার পরামর্শ চান। একপর্যায়ে নয়জন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেন, ঝরে পড়া শিশুদের বিনে পয়সায় পড়াবেন।
সরেজমিনে আশার আলোয়: নাগেশ্বরী উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে সব্যসাচী সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়। এক বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা গেল পাঠদান চলছে। এ প্রতিবেদককে দেখে এগিয়ে এলেন ওরা নয়জন। বিশ্বজিৎ, আসাদুল হক, আহসান হাবিব, রিপন রায়, কফিল উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, এরশাদুল হক, সফিকুল ইসলাম ও আবদুর রাজ্জাক। তাঁদের সঙ্গে শ্রেণীকক্ষে ঢুকতেই শিক্ষার্থীরা সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। ৩৫ জন শিশু পড়ছে এখানে। বিশ্বজিৎ জানালেন, এখানে পড়াশোনা করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অনেকেই খুব ভালো করছে। তাঁরা সব মিলিয়ে অন্তত ২০০ শিশুকে চারটি কেন্দ্রে পড়াচ্ছেন।
গাছের নিচে পাঠদান: কলেজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কয়েক দিনের মধ্যে গ্রাম ঘুরে ঝরে পড়া ২৭টি শিশুকে খুঁজে বের করেন তাঁরা। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি নতুন বছরে নতুন স্বপ্ন নিয়ে পড়ানো শুরু হয়। কোথাও জায়গা না পেয়ে স্থানীয় আসকোরনগর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে গাছের নিচে বসে পড়ানো শুরু। তবে ২২ দিন পর স্থানীয় কয়েকজনের সহায়তায় আজমাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ পাওয়া যায়। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পাঠদান কেন্দ্রের নামও দেওয়া হয় ‘আশার আলো পাঠদান কেন্দ্র’।
ভালো কাজে সমস্যা হয় না: ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা এতই অভাবী যে খাতা, পেনসিল কিনতেও পারে না। অনেকেই না খেয়ে আসে। এসব দেখে খারাপ লাগে তরুণদের। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, টিউশনি করে যা পাওয়া যায় তা দিয়েই পাঠদান চালিয়ে যাওয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন সামর্থ্যবান এক বন্ধু। তিনি প্রস্তাব দেন, ‘তোমাদের কাজে সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করব। তবে একটি শর্ত, আমার নাম প্রকাশ করা যাবে না।’ এতে নয় তরুণের উৎসাহ বেড়ে যায়। নিষ্ঠার সঙ্গে শিশুদের পড়াতে থাকেন তাঁরা।
এর মধ্যে একদিন পাশের গ্রামের রফিক, দুলাল, আলমগীরসহ কয়েকজন আসেন বিশ্বজিৎদের সঙ্গে দেখা করতে। বিশ্বজিৎদের পরামর্শ নিয়ে ২০১০ সালের ৬ জুন তাঁরা নাখারগঞ্জ সব্যসাচী সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে ঝরে পড়া শিশুদের পড়ানো শুরু করেন।
এরপর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ডিগ্রি কলেজের ছাত্র সোবহান, রফিকুলসহ পাঁচজন আসেন বিশ্বজিৎদের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁদের একজন বিশ্বজিৎকে বলেন, ‘তোমাদের মতো করে কাশিপুরে অভাবী শিশুদের পড়াতে চাই।’ পরে তাঁরাও এলাকায় গিয়ে ৫০ জন শিশুকে পড়ানো শুরু করেন। কাশিপুর দক্ষিণ ধর্মপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিনয় চন্দ্র ও কাশিপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ দিলীপ কুমার সেন তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন।
বিশ্বজিৎদের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাশের শিয়ালকান্দি গ্রামের আবদুল হাই, শাকিল, মোস্তফা কামালসহ কয়েকজন গত বছরের ১ মার্চ শিয়ালকান্দি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ৪২ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানো শুরু করেন।
এ ছাড়া রামখানা ইউনিয়নের নাখারগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়, চাঁদেরহাট নিম্নমাধ্যমিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও পশ্চিম রামখানা দীঘিরপাড় উচ্চবিদ্যালয়ে শিশুদের পড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে শিয়ালকান্দি উচ্চবিদ্যালয় ও সব্যসাচী মহাবিদ্যালয় ছাড়া অন্য কেন্দ্রগুলোতে বিশ্বজিতের নেতৃত্বে পড়ানো চলছে।
ফল: গত বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় আশার আলো থেকে ১২০ জন অংশ নেয়। পাসের হার শতভাগ। এদের মধ্যে ‘এ’ প্লাস পেয়েছে ২৩ জন। ‘এ’ ৬৭ জন। গত ২৩ জানুয়ারি এই শিশুদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
ওদের কথা: আজমাতা বিদ্যালয় কেন্দ্রে কথা হয় সেখানে পড়তে আসা শিশু মাসুদ রানার সঙ্গে। মাসুদ জানায়, অভাবের কারণে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে জমিতে কাজ শুরু করে। আশার আলোয় পড়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এবার ‘এ’ প্লাস পেয়েছে।
রোমানা আখতার জানায়, দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সে বলে, ‘বিশ্বজিৎ স্যারেরা বাবা-মাকে বুঝিয়ে আমাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। আশার আলোয় পড়ান। এ কারণেই সমাপনী পরীক্ষায় “এ” প্লাস পেয়েছি।’ একই রকম কথা জানালো মমতাজ, মহসিন, মুক্তা, পারভিনসহ অনেকে।
তরুণেরা যা বলেন: শুরুর দিকের নানা বাধার কথা জানালেন তরুণেরা। একজন বলেন, ‘ঝরে পড়া শিশুদের বাবা-মা বেশির ভাগই নিরক্ষর হওয়ায় তাঁদের বুঝিয়ে ছেলেমেয়েদের আনতে অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমরা কাজ চালিয়ে যাই।’ জানালেন, টিউশনি করে পাওয়া টাকা আর বিভিন্নজনের টুকটাক সহায়তা দিয়েই শিশুদের পড়াশোনার উপকরণ কিনে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নিজেরাও ভালোভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ২০১১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় বিশ্বজিৎ জিপিএ-৫ পেয়েছেন। পাস করেছেন অন্যরা।
এই তরুণেরা মাদক ও অশালীন নৃত্যের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। ইতিবাচক বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গঠনের কাজ করে যাচ্ছেন। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গত বছর একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। তাঁদের মতে, এলাকার পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে।
স্থানীয়দের বক্তব্য: রামখানা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শহীদুর রহমান তালুকদার বলেন, এই ছেলেরা শিক্ষিত ও সুস্থ সমাজ গঠনে কাজ করছেন। স্থানীয় শিক্ষক আফছার আলী বলেন, ঝরে পড়া শিশুদের পড়িয়ে ভালো ফল করে ওরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, চেষ্টা করলে সব হয়।
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল হক বলেন, ‘আশার আলো পাঠদান কেন্দ্র সম্পর্কে শুনেছি। কয়েকজন তরুণ মিলে বেশ ভালো কাজ করছেন।’

No comments

Powered by Blogger.