সাংস্কৃতিক সম্পদ-নকশিকাঁথার মেধাস্বত্ব অধিকার by পাভেল পার্থ

কবি চন্দ্রাবতী রামায়ণ কাব্যে সীতার নকশিকাঁথা সেলাইয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সীতার গুণের কথা কি কহিব আর/ কাঁথায় আঁকিল কন্যা চান সুরুজ পাহাড়/ আরও যে আঁকিল কন্যা হাঁসা আর হাঁসি/ চাইরো পাড়ে আঁকে কইন্যা পুষ্প রাশি রাশি’।

পল্লিকবি নামে পরিচিত জসীমউদ্দীন তাঁর নকসীকাঁথার মাঠ গ্রন্থে গ্রামীণ জনপদের যাপিত জীবন কাঁথা কারিগর নিম্নবর্গের বয়ানে হাজির করেছেন। নকশিকাঁথার নানান নকশার নানান নাম। যেমন—কাঁথার জমিনের কাজের ভেতর চইলতা ফুল, শঙ্খলতা, বাঁশপাতা ফোঁড়, তেজবি ফোঁড়, বরকা ফোঁড়, বিছা ফোঁড়, কইতা ফোঁড়। আবার কাঁথার পাড়েরও হরেক রকমের নাম। তাস পাড়, ঝুমকালতা পাড়, তোলো পাড়, নয়নলতা, লক্ষ্মীর পাড়, গুরুখধান্ধা পাড়, নৌকাবিলাস, নারকেলপাতা পাড়। ঐতিহাসিকভাবেই সারা দেশের গ্রামীণ নারীরা বৈচিত্র্যময় বুনন ও নকশারীতি দিয়ে গড়ে তুলেছেন গ্রামজীবনের অবিস্মরণীয় নকশিকাঁথার আখ্যান।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অসম বাণিজ্য চুক্তির ছুতোয় বাসমতী চাল, আলফন্সো আম এবং স্কচ হুইস্কির বাণিজ্যিক মালিকানা নিয়ে বিশ্বব্যাপী দেনদরবার শুরু হলে পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশনার প্রসঙ্গখানি বাণিজ্য-দুনিয়ায় আরেক ঝামেলা নিয়ে হাজির হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২৩টি অসম ও অন্যায্য চুক্তিতেই বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, যার একটি হচ্ছে ‘বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি বা ট্রিপস’। এই ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারায় দুনিয়ার সব প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। আবার ২২ ও ২৩ ধারায় ভৌগোলিকভাবে নির্দেশিত পণ্যের জন্য কিছু আইনগত স্বীকৃতির কথাও বলা হয়েছে। ট্রিপস চুক্তির ধারা মেনেই ভারত নিজস্ব ‘সুই-জেনেরিস’ আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যকে নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশনা হিসেবে নিবন্ধিত করছে। ভারত এপ্রিল ২০০৪ থেকে এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত ১১৭টি পণ্যকে নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য দরখাস্ত করেছে। এর ভেতর বাংলাদেশের অনন্য ভৌগোলিক নির্দেশনা নকশিকাঁথা, জামদানি শাড়ি ও ফজলি আমও রয়েছে। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের উপ্পাদা কোথাপল্লি মণ্ডলের বেশ কিছু গ্রামের তাঁতিসমাজ, দুটি নিবন্ধিত তাঁতিদের সংগঠন ২০০৯ সালে ‘উপ্পাদা জামদানি’ নামের জামদানি শাড়িকে তাদের নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করেছে। পাশাপাশি নকশিকাঁথাকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলো নকশিকাঁথাকে নিজেদের নিজস্ব পণ্য হিসেবে আইনগত নিবন্ধনের জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
এভাবেই জামদানি, নকশিকাঁথা, ফজলি আমের ওপর রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর ফলে পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দর-কষাকষি থেকে শুরু করে পণ্যের মেধাস্বত্ব মালিকানাও লাভ করবে ভারত। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের জামদানি তাঁতশিল্প এবং জামদানি কারিগর ও নকশিকাঁথা বুননশিল্পীদের প্রথাগত জীবনের অধিকার। সৃজন ও মননশীল শিল্পের মেধাস্বত্ব অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সনদের সমর্থক বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্রই। উভয় রাষ্ট্রই জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (সিবিডি ১৯৯২) স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে, যেখানে প্রাণসম্পদসহ লোকায়ত জ্ঞান সুরক্ষার অধিকারের প্রসঙ্গটি জোরালোভাবেই আছে। হলুদ ও বাসমতী চালের পেটেন্ট নিয়ে আন্তর্জাতিক বিতর্কের একপর্যায়ে ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠান ১৯৯৯ সালে দেশের লোকায়ত জ্ঞান সুরক্ষার জন্য ট্র্যাডিশনাল নলেজ ডিজিটাল লাইব্রেরি (টিকেডিএল) তৈরি করে। বাংলাদেশেও পেটেন্টস অ্যান্ড ডিজাইনস অ্যাক্ট, ১৯১১; পেটেন্টস অ্যান্ড ডিজাইনস রুল, ১৯৩৩; ট্রেডমার্কস অ্যাক্ট, ১৯৪০; ট্রেডমার্কস রুলস, ১৯৬৩ কার্যকর আছে। পাশাপাশি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন কপিরাইট (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০০৫ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের জন্য ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ, ২০০৮’ নামের একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করেছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য বিষয়ে বাংলাদেশ কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে, এ সম্পর্কে মতামত দিয়ে খসড়াটি তৈরিতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করেছে। অধ্যাদেশটিতে শিল্প মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের তিনটি মৎস্য পণ্য, ১২টি ফল, ১১টি প্রক্রিয়াজাত খাবার, আটটি শাকসবজি, ১৪টি কৃষিজাত পণ্যসহ মোট ৪৮টি খাদ্যপণ্য এবং খাদ্য বাদে ১৮টি পণ্য মিলিয়ে ৬৬টি পণ্যকে বাংলাদেশের জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। খসড়া তালিকাটিতে জামদানি শাড়ি, ফজলি আম এবং নকশিকাঁথাকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
গ্রামবাংলার ধান, নকশিকাঁথা, কাসুন্দি, আচার, ভেষজ ও পিঠা, পাবনা শাড়ি, হাওরের নানিদ মাছ, চান্দারবিলের কৈ, ঢাকাই জামদানি, বাবুরহাটের তাঁত, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেইন তাঁতে বোনা কাপড়, বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ মণিপুরি শাড়ি ও চাদর, রংপুরের শতরঞ্জি, মিরপুর কাতান, বাংলার কালো ছাগল, চট্টগ্রামের লবণ, মুন্সিগঞ্জের কলা, ঠাকুরগাঁওয়ের সূর্যপুরী আম, যশোরের খেজুর গুড়, দিনাজপুরের কালিজিরা ধান, কালিয়াকৈরের ধনীর চিড়া, হাওর অঞ্চলের ধামাইল গান, উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গীত, দক্ষিণাঞ্চলের গাজীর গান, ঝিনাইদহের হরি ও ম্যানেজার ধান, সুন্দরবনের মধু, টাঙ্গাইল শাড়ি, বগুড়ার দই, সিলেটের সাতকরা, পদ্মার ইলিশ, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, মধুপুরের আনারস, মুক্তাগাছার মন্ডা, শ্রীমঙ্গলের খাসিয়া পান ও চা, পোড়াবাড়ীর চমচম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, বান্দরবানের বম চাদর, কুমিল্লার খাদি, রুহিতপুরী লুঙ্গি, যশোরের জামতলার রসগোল্লা, পটুয়াখালীর নাপ্পি, কুলিয়ারচরের সিদল শুঁটকি—এ রকম অসংখ্য ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যই চলমান রেখেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব। দুনিয়ার সব ভূগোলে, সব যাপিত জীবনেই এ রকম বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক নির্দেশনা আছে।
বাংলাদেশের নকশিকাঁথা, জামদানি ও টাঙ্গাইল শাড়ি পৃথিবীব্যাপী পরিচিত ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। সরকারের দায়িত্ব জনগণের অনুমোদন সাপেক্ষে দ্রুত ভৌগোলিক পণ্য নির্দেশক অধ্যাদেশটি কার্যকর করে দেশের ভৌগোলিক পণ্যগুলোর জনমালিকানা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি নকশিকাঁথা, জামদানি শাড়ি এবং ফজলি আমসহ উভয় রাষ্ট্রে বিরাজমান অন্যান্য ভৌগোলিক নির্দেশনার বিষয়ে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভেতর দিয়ে একটি কার্যকর জনবান্ধব সমাধানে পৌঁছানো জরুরি। জাতীয় সংসদ, সার্ক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের নকশিকাঁথা ও জামদানি শাড়ির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রশ্নটি কার্যকরভাবে উত্থাপন করা জাতীয় তাঁত বোর্ড, বস্ত্র-বাণিজ্য-পররাষ্ট্র ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
গবেষক: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.