কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট পড়ানো ও নোটবই বন্ধ করতে হবে-শিক্ষার মানোন্নয়ন

স্বাধীনতার ৪০ বছরেও আমাদের শিক্ষার হার এখনো ৬০ শতাংশে পৌঁছাতে পারেনি। অর্থাৎ, এখনো দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নিরক্ষরতার অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরজা পেরোনোর আগেই তাদের একাংশ ঝরে পড়ে।

মাধ্যমিকেও ঝরে পড়ে উল্লেখযোগ্য হারে। আলোহীন, আশাহীন তাদের জীবন। কিন্তু ঝরে না পড়া শিশু-কিশোরেরা কী শিখছে, কতটা শিখছে, তা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কখনো কি খতিয়ে দেখেছেন? দেখলে শিক্ষার ফাঁকিটা ধরা পড়ত। পাসের হার বাড়াতে নানা কায়দা-কৌশল করলেও মান বাড়ানোর দিকে তাঁদের একদম নজর নেই।
শিক্ষার মান অবনমন নিয়ে গোটা দেশের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রতিধ্বনিত হয়েছে সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে সম্মিলিত প্রচেষ্টা’ নামের একটি সংগঠন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে। সংগঠনের আহ্বায়ক ও নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা যথার্থই বলেছেন, ‘শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞানার্জন, কোচিং বা গৃহশিক্ষকের সহায়তায় একটি সনদ অর্জন নয়। জ্ঞান হচ্ছে মানুষের অন্তরের আলোস্বরূপ।’ বেঞ্জামিন কস্তা প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং সেন্টারকে শিক্ষার মান অবনমনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, শিক্ষকেরা যদি ঠিকমতো ক্লাস করেন, তাহলে প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারে পড়ানোর প্রয়োজন হয় না। ঢাকার বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষদের উদ্যোগে গঠিত ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে সম্মিলিত প্রচেষ্টা’র উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকাই প্রধান। সারা দেশের শিক্ষকদের কাছ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ প্রত্যাশিত। শিক্ষকেরা ক্লাসে ঠিকমতো পড়ালে নোটবই ও কোচিং সেন্টারের প্রয়োজন হয় না। তবে শিক্ষার্থীরা যাতে কোচিং সেন্টার ও নোটবইমুখী না হয়, সে জন্য অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
সৃজনশীল প্রশ্ন-পদ্ধতি চালু হওয়ার পর নোটবইয়ের চাহিদা কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা কমার কোনো লক্ষণ নেই। এটি আমাদের পাঠ ও পঠন পদ্ধতির বড় দুর্বলতা। এসব দূর করার দায়িত্ব শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তথা শিক্ষা প্রশাসনের। শিক্ষার মানোন্নয়নের পূর্বশর্ত মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ এবং পঠন-পাঠনে নিবিড় তদারকি। কাজটি শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ছেড়ে না দিয়ে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তিদের এই পেশায় আগ্রহী করতে হলে বেতন-ভাতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আধপেটা খেয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হওয়া যায় না। ভারতের শিক্ষকদের তুলনায় আমাদের দেশের শিক্ষকেরা অনেক কম বেতন পান। শিক্ষকেরা ভালো বেতন-ভাতা পেলে প্রাইভেট পড়াতেও নিরুৎসাহিত হবেন। কেবল পাসের হার নয়, শিক্ষার মানের ব্যাপারেও সরকারের মনোযোগ বাড়াতে হবে। শুধু আইন করে প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং সেন্টার ও নোটবই পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। তবে ক্লাসে উত্তম পাঠ ও পঠনের পাশাপাশি শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহির মাধ্যমে শিক্ষার এই দুষ্ট ক্ষতগুলো মুছে ফেলা অসম্ভব নয়।

No comments

Powered by Blogger.