শাসক বদল-লিবিয়া যুদ্ধের কী হলো? by স্টিফেন এম ওয়াল্ট

মাত্র কয়েক দিন আগেও প্রতিদিন মার্কিন সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় জায়গা পেত লিবিয়ার যুদ্ধ। রক্তবন্যা বন্ধ করার মানবিক কারণ এবং ‘আরব বসন্তে’র গতিশীলতা বজায় রাখতে যে যুদ্ধ খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল, তার এখন কী হলো? ওবামার বশংবদ আইনজীবীদের দাবি অনুযায়ী, এটাতে ‘যুদ্ধবিগ্রহ’-এর ব্যাপার নেই।

বোঝা যায়, যুদ্ধক্ষমতাবিধির আবশ্যক শর্তাবলি এড়ানোর জন্যই এসব কসরত।
যুদ্ধ এখনো চলছে। কোনো কোনো দিন পত্রিকার ভেতরের পাতায় কিছুটা জায়গাও করে নেয় এই যুদ্ধ। দ্রুত ও সহজ জয় পাওয়ার আশা বহু আগেই ভেঙে চুরমার। বিদ্রোহীদের প্রতি ন্যাটোর পৃষ্ঠপোষকতা হয়তো অব্যাহত থাকবে। সে ক্ষেত্রে গাদ্দাফির পরিবার/শাসনের অবসান ঘটাতে বিদ্রোহীরা ধীরে ধীরে হয়তো সফল হতে পারে। যদিও ইদানীং কিছু ইউরোপীয় নেতা (যেমন ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী) বলছেন, আলাপ-আলোচনার পথেই যেতে হবে। ন্যাটো জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্য যে ততটা জোরালো নয়, সে ইশারাই মেলে এখান থেকে। তবে যদি গাদ্দাফির বিদায় ঘটে, তাহলে উদারনৈতিক যুদ্ধবাজ নেতারা সেটাকে তাঁদের বিজয় মনে করবেন এবং হিসাব-নিকাশে তাঁদের গলদ ও খামখেয়ালে ভরা এই যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি পরিণতির ব্যাপারে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করবেন।
এবার তিনটি চিন্তার অবতারণা করব। প্রথমত, লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে প্রধান যুক্তি ছিল গাদ্দাফি বাহিনী বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি বেনগাজি দখল করে নিলে সম্ভাব্য ‘রক্তবন্যা বওয়ার’ আশঙ্কা; আরেক যুক্তি ছিল গাদ্দাফি বিজয়ী হতে দিলে পুরো আরব বসন্ত লাইনচ্যুত হয়ে পড়ার শঙ্কা। ভয়টা আসলে ‘প্রতিসংক্রমণের’: গাদ্দাফির মতো লুটেরা স্বৈরাচারী যদি বলপ্রয়োগে লিবিয়ায় ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন, তাহলে একইভাবে অন্য স্বৈরাচারীরা জোর পাবেন এবং যেসব প্রগতিশীল শক্তি গণজাগরণের সূচনা করেছে, তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে। তাই বিপ্লবী জোয়ার সামনে এগিয়ে নিতে হলে গাদ্দাফির বিদায় ঘটাতেই হবে।
এখন এটা প্রতারক যুক্তি বলে মনে হয়। মূল বিপ্লবী ঢেউয়ের ভেতর সংক্রামক উপাদান ছিল। তিউনিসিয়া থেকে বিস্তৃত হয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মিসরে, লিবিয়ায়, ইয়েমেনে, বাহরাইনে ও সিরিয়ায় চলে গেছে। তবে রাজনৈতিক সংক্রমণের অন্যান্য দৃষ্টান্তের মতোই প্রতিটি ক্ষেত্রে কী পরিণতি ঘটবে, তা নির্ভর করেছে প্রত্যেক দেশে জায়গাতেই স্থানীয় ও বহিস্থ শক্তিগুলোর সমাবেশের ওপর; অন্য কিছু দেশে তখন কী ঘটছিল, তার ওপর নয়। মিসরের পরিণতি সিরিয়া বা ইয়েমেনের থেকে খুবই ভিন্ন রকম। লিবিয়া, বাহরাইন ও মরক্কোও আলাদা পথে গেছে। মোটা দাগে, লিবিয়াতে যা ঘটেছে তার কোনো প্রভাবই হয়তো পড়েনি আরব বিশ্বের অন্যত্র কী ঘটেছে তার ওপর। আর পড়লেও তা অতি নগণ্য। সোজা কথায়, ন্যাটো যদি লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ না করত আর গাদ্দাফি সন্দেহাতীতভাবে জিতে যেত, তবু সিরিয়ায় আসাদকে বিপদে পড়তেই হতো বলে মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, লিবিয়ায় ন্যাটো হামলা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু ব্যক্তি ১৯৯৯ সালের কসোভো যুদ্ধের সঙ্গে এর তুলনা করল। উভয় যুদ্ধই সূচিত হয়েছিল প্ররোচনা থেকে। কোনোটাতেই কৌশলগত গুরুতর কোনো স্বার্থ জড়িত ছিল না। আর উভয় ক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনায় বিমানশক্তি ব্যবহার করে খুব বেশি মূল্য দিতে হয়নি। ন্যাটোর নেতারা আশা করেছিলেন, তাঁদের লক্ষ্যবস্তুগুলো দ্রুতই তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু শত্রুপক্ষ (১৯৯৯ সালে মিলোসেভিচ, আজ গাদ্দাফি) এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকছে দেখে তাঁরা বিস্মিত হয়েছিলেন।
তবে আরেকটি মিলও আলোচনায় আসার দাবি রাখে। শেষ পর্যন্ত সার্বিয়া আত্মসমর্পণ করেছিল। আশা করি, গাদ্দাফি বা তাঁর ছেলেরাও অবশেষে তা-ই করবেন। তবে কসোভোতে ন্যাটো ও জাতিসংঘকে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে হয়েছিল। ১০ বছর পর এখনো সেখানে আছে তারা। কসোভোর জনসংখ্যা লিবিয়ার মাত্র ২৮ শতাংশ। ভৌগোলিক দিক দিয়েও কসোভো ক্ষুদ্রতর (লিবিয়ার ১৮ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিপরীতে কসোভোর আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার)। তাই যারা মনে করে ন্যাটো, জাতিসংঘ অথবা ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ তাদের কাজ সম্পন্ন করবে তখনই যখন গাদ্দাফি তাদের চাচা বলবেন (অথবা ন্যাটোর বিমান হামলায় মারা যাবেন), সেই মানুষদের প্রত্যাশা কমিয়ে গভীরভাবে বিভক্ত দেশটিতে হয়তো দীর্ঘ মেয়াদে সম্পৃক্ত থাকার প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
তৃতীয়ত, এই ক্ষুদ্র যুদ্ধ নতুন একটি শব্দের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবতে উৎসাহ জুগিয়েছে। ‘প্রয়োজনীয় যুদ্ধ’ ও ‘পছন্দের যুদ্ধের’ মধ্যকার পার্থক্য সবারই জানা। এ দুইয়ের পার্থক্যরেখা কখনো কখনো ঝাপসা। তবে যে যুদ্ধে গুরুতর কৌশলগত স্বার্থ (এবং জাতীয় অস্তিত্বও হয়তো) বিপন্ন হয়, সে যুদ্ধকে আমরা সাধারণত প্রথম ভাগে ফেলি। অন্যদিকে, দ্বিতীয়টির মধ্যে ফেলা হয় সেসব যুদ্ধকে, যেখানে কৌশলগত অথবা মানবিক বিবেচনায় যুদ্ধে কোনো তাৎক্ষণিক অথবা জরুরি আবশ্যক প্রাপ্তির ব্যাপার থাকে না, যদিও সবকিছু ঠিকঠাক চললে কিছু কৌশলগত সুবিধা পাওয়া যেতেই পারে। এই দুই শ্রেণীর যুদ্ধের সঙ্গে আরেকটি শ্রেণী যুক্ত করার প্রস্তাব করছি, ‘খামখেয়ালের যুদ্ধ’। কিছু প্রতিপত্তিশালী রাজনীতিক যে কারণে প্রতারণার আশ্রয় নেন, সেই একই কারণে প্রতাপ ও প্রতিপত্তিশালী কিছু রাষ্ট্র এ প্রকারের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়: কারণটি হলো, তারা তা করার ক্ষমতা রাখে।
এসব যুদ্ধ শুরু করতে নেতৃত্ব দেন যাঁরা, তাঁরা তাঁদের কাজের পেছনে যুক্তি দেখাতে পারেন না এমন নয়। মানবজাতির সৃজনশীলতা সীমাহীন। আর শক্তিধর রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের যৌক্তিকতা সব সময়ই তৈরি করতে সক্ষম। যুদ্ধের প্রবক্তারা হয়তো তা বিশ্বাসও করেন। খামখেয়ালের আভিধানিক অর্থ ‘আকস্মিক অথবা মর্জিমাফিক ধারণা, খেয়ালখুশি’। ‘খামখেয়ালের যুদ্ধ’ ঠিক তা-ই। এমন যুদ্ধে পরাশক্তিরা জড়িয়ে যায় সতর্ক প্রস্তুতি অথবা ভাবনাচিন্তা না করেই, এর প্রয়োজনীয়তা অথবা ন্যায্যতা নিয়ে জনসমক্ষে আলোচনা না করেই এবং প্রারম্ভিক অনুমান ও প্রত্যাশা পূরণ না হলে কী হবে, সেই চিন্তা না করেই। খামখেয়ালের যুদ্ধ কোনো দেশকে হয়তো আপনাআপনি দেউলিয়া বানিয়ে ফেলবে না অথবা বড় ধরনের কৌশলগত ওলট-পালট ঘটার দিকেও নিয়ে যাবে না। তবে যে সময়ে বিশ্বনেতাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করা উচিত অত্যন্ত বড় কিছু বিষয়ে (যেমন অর্থনীতি), তখন মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার আরেক উপায় এসব যুদ্ধ।
সুতরাং, আশার জায়গা হয়তো এতটুকুই যে, আমরা আর লিবিয়া যুদ্ধের প্রতি ততটা মনোযোগী নই—এ থেকেই লিবিয়া যুদ্ধ আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা কি বোঝা যায় না?
ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
স্টিফেন এম ওয়াল্ট: যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.