মানুষের মুখ-পাতা চাঁইয়ে বাঁধা জীবন

শীতের সকাল। হামাগুড়ি দিয়ে সূর্য উঠে এসেছে অনেকটা মাথার ওপর। রৌদ্রস্নাত মুক্তেশ্বরী। বড়ই মিষ্টি রোদ। তেতে ওঠা রোদে নদীর পাড়ে দুই পা ছড়িয়ে আপন মনে চাঁই মেরামত করে চলেছেন অশীতিপর এক বৃদ্ধ। বয়সের ভার কোমরটা বাঁকিয়ে দিয়েছে তাঁর। পুরোপুরি।

অনেকটা ধনুকের মতো। জীর্ণ-শীর্ণ শরীর। তবু থেমে থাকেনি তাঁর জীবনের গতি। এতটুকুও। কাজ করে চলেছেন তিনি। নিরন্তর।
নাম তাঁর পাগল মল্লিক। বয়স ৮৫। বাড়ি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পাঁচকাটিয়া গ্রামে। মুক্তেশ্বরী নদী তাঁর দেবতা। তাঁর অন্নদাতা। এই নদীর বুকে চাঁই পেতে ধরা মাছ বিক্রি করে সংসার চলে তাঁর। তিনি নিজেই এখন একটি সংসার।
ছোট সংসার ছিল পাগলের। স্ত্রী ও একমাত্র ছেলের সংসারে ছিল অনাবিল আনন্দ। এলাকার এমনকি দূর-দূরান্তের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত যোগদান করতেন তিনি। যেতেন ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও। কিন্তু সংসারে সুখ বেশি দিন রইল না। হঠাৎ এসে লাগল দুঃখের ঝাপটা। সেটা ১৫ বছর আগে। ছেলে বীরেন মল্লিক বিষপানে আত্মহত্যা করল। এলোমেলো হয়ে গেল সংসারটি। ভেঙে পড়লেন পাগল মল্লিক। সময়ের ব্যবধানে আস্তে আস্তে শিরদাঁড়া সোজা করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন তিনি। সফলও হলেন অনেকটা। কিন্তু ঝড় উঠল আবার। গেল শ্রাবণে। ক্যানসারে মারা গেলেন স্ত্রী পূর্ণিমা মল্লিক। বড্ড একা হয়ে পড়লেন তিনি। বেঁচে থাকার তাগিদ বড় হয়ে দেখা দিল জীবনে। নেমে পড়লেন তিনি নতুন জীবনসংগ্রামে। মুক্তেশ্বরীই হয়ে উঠল তাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। পাথেয়।
মুক্তেশ্বরীর পাড়ে জন্ম তাঁর। বেড়ে উঠেছেন নদীটির জোয়ার-ভাটার মতো। সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর সখ্য নদীটির সঙ্গে। নদীকে তিনি দেখেছেন নানারূপে, নানাভাবে। তিনি দেখেছেন, একসময়ের স্রোতস্বিনী ধীরে ধীরে কীভাবে স্রোতহীনা হয়ে গেল। মুক্তেশ্বরীর বুক থেকে হারিয়ে গেল পালতোলা নৌকা। থেমে গেল মাঝির ভাটিয়ালি গান। সে কথা বলতে বলতে কণ্ঠ ভারী ওঠে পাগল মল্লিকের। কিছুক্ষণ নিজেকে সামলান। তারপর আবার বলেন। মুক্তেশ্বরীকে মানুষ মেরেছে গলাটিপে। কিন্তু মুক্তেশ্বরী মানুষ মারেনি। বরং উজাড় করে দিয়ে চলেছে তার সবকিছু। তার বুকে জমানো সমস্ত ধন। তার বুক আঁকড়ে বেঁচে আছে এলাকার শত শত পরিবার।
পাগল মল্লিকের চাঁই আছে ছয়টি। সবই তৈরি করেছেন তিনি। মুক্তেশ্বরী নদীতে সেগুলো পাতা থাকে সব সময়। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। এরপর সোজা চলে যান বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক শ গজ দূরে মুক্তেশ্বরী নদীতে। পাতা চাঁই থেকে মাছ ছাড়িয়ে বাড়ি আসতেই পূর্বাকাশে উঁকি দেয় সূর্য। জ্যান্ত চিংড়ি মাছ ঘরের পাশের গর্তে ছেড়ে দেন। এরপর শুরু করেন রান্নার কাজ। তিন বেলার জন্য। সকালের খাবার খেয়ে মাছ বিক্রি করতে যান পাশের বাজারে। বাড়ি ফিরতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে মাছের গুঁতোয় ভেঙে যাওয়া চাঁই মেরামত করেন নদীর পাড়ে বসে। বিকেলে প্রতিবেশী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসে গল্প করেন। কখনো কখনো যান ঠাকুর দর্শনে। সন্ধ্যায় পুজো সেরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। পাগল মল্লিক জানান, প্রতিদিন একবার করে চাঁই থেকে মাছ ছাড়াতে হয়। চাঁইয়ে বাইন, গুঁতে, পুঁটি, পাবদা, ছোট চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, কৈ, টেংরা, শোল ও পোনা মাছ বাঁধে। তিনি জানান, গর্তে ছাড়া মাছ বিক্রি করা হয় ফাল্গুন-চৈত্র মাসে। মাছ বিক্রি করা টাকায় ভালোই সংসার চলে তাঁর।
ছোট্ট একটি মাটির ঘর। ওপরে টিনের ছাউনি। এই ঘরে থাকেন পাগল মল্লিক। পেশা তাঁর চাঁই দিয়ে মাছ ধরা। নেশা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা। কিন্তু মাজা পড়ে যাওয়ায় এখন এসব অনুষ্ঠানে তিনি যোগদান করতে পারেন না ঠিকমতো। তিনি বলেন, ‘জীবনে কষ্ট আছে, দুঃখ আছে। কাজের মধ্যে থেকে দুঃখকে ভুলে যাই। বেশি দুঃখ করলে আমি যে পাগল হয়ে যাব। আমার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে আমি সুখী।’
মুক্তেশ্বরী তাঁকে টানে। এক দুর্নিবার আকর্ষণে। অহর্নিশ। তাই তো সময়ে-অসময়ে তিনি ছুটে যান নদীর পাড়ে। নদীর বুকে দাপিয়ে বেড়ানো মাছ মিটিয়ে দেয় তাঁর পেটের জ্বালা। নির্মল বাতাস জুড়িয়ে দেয় সমস্ত দেহ-মন। গভীর প্রশান্তিতে বাড়ি ফেরেন তিনি। পেছনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মুক্তেশ্বরী।
 মাসুদ আলম

No comments

Powered by Blogger.