তবুও স্বপ্ন by জাকির তালুকদার

তবুও যে বাংলাদেশ নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে সাহস পাই এখনও, তার কারণ_ মানুষ। ষোলো কোটি মানুষ। মানুষকে কখনও সংখ্যাতত্ত্ব এবং হিসাবের ফেরে বাঁধা যায় না। মানুষ চিরকালই অঙ্কশাস্ত্রের কাছে রহস্যই থেকে যাবে। বাংলাদেশের মানুষও প্রচলিত রাষ্ট্রশক্তি এবং করপোরেট মোড়লদের কাছে এক বিরাট রহস্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।

বলা যেতে পারে, দাঁড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। তাদের কাছে যেটি রহস্য, আমাদের কাছে সেটিই শক্তি। সেই শক্তি এবং রহস্যময়তার একটি ব্যাপক রূপ দেখেছে বর্তমান পৃথিবীর মোড়ল-সমাজ। ১৯৭১ সালে সেই মোড়লদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকে স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে দিয়েই রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা এনেছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ


মানুষের কয়েকটি অনুভূতিই নিশ্চিত করে দেয় সে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন কি-না। নানা ধরনের রাষ্ট্রনৈতিক সংজ্ঞার বাইরে থেকেও মানুষ স্বাধীনতাকে শনাক্ত করতে পারে সেই অনুভূতিগুলোর মাধ্যমেই। সেই অনুভূতি হচ্ছে নিরাপত্তার অনুভূতি। নিজের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা, নিজের মাটিতে নিজের ফলানো ফসল নিজের গোলায় তুলতে পারার নিশ্চয়তার অনুভূতি, নিজেদের মাটি, নিজেদের সমাজ, নিজেদের দেশ যাদের জিম্মায় দেওয়া আছে, তারা যে নিজেদেরই মানুষ_ এই আশ্বস্ততার অনুভূতি। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বাইরে দেশ আমাদের জন্য যে সর্বজনীন সম্পদগুলো দিয়েছে_ সেই তেরোশ' নদী, সবুজ মাটির ওপর আচ্ছাদন বিছিয়ে রাখা আকাশ, নিঃশ্বাসের বরাভয় নিয়ে বয়ে চলা বাতাস, মাটির নিচে জমা করে রাখা খনি_ এসব সম্পদ লুট না হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তির অনুভূতি।
রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা অর্জনের চলি্লশ বছর পরে আমাদের অনুভূতি কী বলে? আমরা মানে, সবধরনের ক্ষমতা বলয়ের বাইরে থাকা শতকরা সাতানব্বই ভাগ মানুষ। স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ এবং অনুভূতি থেকে বঞ্চিত থেকেও একটি পতাকা নিয়ে গর্ববোধ করা মানুষ।
০২.
বলা হয়ে থাকে, হাজার বছর পরে বাঙালির প্রথম স্বাধীন ভূখণ্ডটির নাম এই বাংলাদেশ। হাজার বছরে অনেকবার খাত বদলিয়েছে তেরোশ' নদী। অনেকবার পরিবর্তিত হয়ে গেছে ভূমির বিন্যাস। অনেকবার স্থান ত্যাগ করেছে একাধিক কৌমের মানুষ। অনেকবার পরিবর্তিত হয়েছে স্থাননাম, দেশনাম, রাষ্ট্রনাম, ভূগোলনাম। অঙ্গ, বঙ্গ, রাঢ়, পুণ্ড্র্র, গৌড়, বরেন্দ্র, সমতট_ এসব একাধিক নামে অভিহিত হয়ে বাঙালি হয়ে ওঠা জাতিসত্তাটির ভৌগোলিক চৌহদ্দি। বর্ণগত, ধর্মগত, বৃত্তিগত কারণে এই জাতির একাধিক অংশকে বিভিন্ন সময়ে বৃহৎ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করতে হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ নামে পরিচিত ভূখণ্ডটির বিন্যাস স্থিরীকৃত হয়েছে ১৯৪৭ সালে। ঘটনাক্রমে তখন এই পূর্ববঙ্গে বা বাংলাদেশে বাঙালি জাতির যে অংশটির বসবাস, তারা ছিলেন প্রধানত কৃষিজীবী, কেতাবি শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা, প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে পরিচয়হীন, ক্ষমতার বলয় থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থানকারী, রাজনৈতিক পাশা খেলায় সবচেয়ে অপারদর্শী, কুল-কৌলীন্যহীন আতরাফ গোত্রের মুসলমান। তাদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক নমশূদ্র হিন্দু, কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। বর্ণগর্বী, শিক্ষাগর্বী, চাকরিগর্বী, ধনগর্বী, আভিজাত্যগর্বী, বংশগর্বী ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জনগোষ্ঠী নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছে ভারতের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ নামের ভাগীরথী তীরের ভূখণ্ডটি। তাই বাঙালির রাষ্ট্র বলতে পৃথিবীতে রয়েছে কেবল এই বাংলাদেশ। বাঙালি ও বাঙালিত্ব বলতে যা কিছু বোঝায় সেসবের অস্তিত্ব পুরোপুরি নির্ভরশীল বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর। সে সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন এবং দায়বদ্ধ, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ সুপ্রচুর।
০৩.
অতি সম্প্রতি জোরেশোরে প্রচার করা হচ্ছে একটি বাক্য। 'অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ'। মিথ নির্মাণ এবং মিথের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের চিরকালের বৈশিষ্ট্য। প্রশ্ন উত্থাপন আমরা তেমন একটা করি না। উপরোক্ত বাক্যটিকে মিথের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়। এ পর্যন্ত এই প্রশ্নটি কোনো মহল থেকেই উত্থাপিত হয়নি যে, বাংলাদেশ কি এ দেশের সব অধিবাসীর জন্য অমিত সম্ভাবনার দেশ? নাকি তা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য বয়ে এনেছে সম্ভাবনার আশীর্বাদ? বিগত চলি্লশ বছর এবং বর্তমানের দিনপঞ্জি বলে দিচ্ছে এই 'অমিত সম্ভাবনা' সবার জন্য নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী অল্প কয়েকটি বছর বাদ দিলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি হাঁটছে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক বিকাশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। পুঁজিবাদের বিকাশ এই দেশে আদৌ সম্ভব কি-না সে প্রশ্ন বিভিন্ন সময়ে তোলা হলেও রাষ্ট্রশক্তি সে কথায় কর্ণপাত করেনি। কর্ণপাত করেনি এই প্রশ্নের যে, পুঁজিবাদ মানুষের সর্বজনীন মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে কি-না। পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন পুঁজির। পৃথিবীর আদি পুঁজিবাদী দেশ ও জাতিগুলো সেই পুঁজি সংগ্রহ করেছিল বিশ্বকে লুণ্ঠনের মাধ্যমে। ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ইউরোপের পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলোর উন্নতির ইতিহাস আসলে দস্যুবৃত্তি এবং লুণ্ঠনের ইতিহাস। এশিয়া, আফ্রিকা এবং তৎকালীন আমেরিকা মহাদেশ থেকে মহাভারত কথিত সাগর মন্থনের মতো তারা সম্পদ মন্থন করেছিল কয়েকশ' বছর ধরে। স্বাধীন ও মুক্ত আফ্রিকার মানুষকে পরিণত করেছিল দাসে। এসব কালো মানুষকে লাগিয়েছিল আমেরিকার বিস্তৃত ভূখণ্ডে প্লানটেশনের কাজে। ভারতবর্ষসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ছিল কাঁচামালের জোগানদার। আবার ইউরোপের উৎপাদিত পণ্যের সত্যিকারের মুক্তবাজারও ছিল এসব অধিকৃত ভূখণ্ডই। কাজেই পুঁজির বিকাশ ঘটতে পেরেছে ইউরোপে। আমেরিকা যাদের দেশ, সেই মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হয়ে ওঠে আটলান্টিক পারের ইউরোপই। লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোকে তারা পরিণত করেছিল নিজেদের পণ্যের মুক্তবাজারে। সেখানেও পুঁজির বিকাশ এভাবেই। কিন্তু বাংলাদেশ যখন পুঁজিবাদী পথে হাঁটতে শুরু করেছে, তখন তো এ দেশের পুঁজিপতিদের সামনে লুণ্ঠনের জন্য কোনো দেশ নেই। বাংলাদেশের বিকলাঙ্গ পুঁজি তাহলে বিকশিত হবে কীভাবে? পুঁজিপতি শ্রেণীই-বা গড়ে উঠবে কোন পথে? পথ কিন্তু একটাই। লুণ্ঠন। যেহেতু অন্য দেশ বা জাতিকে লুণ্ঠনের অবকাশ বা শক্তি নেই, তাই এ দেশের পুঁজিপতিরা লুণ্ঠন চালায় নিজেদের দেশের মধ্যেই। লুণ্ঠন চালায় নিজেদের জাতির মানুষের ওপরেই। রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিজেদের প্রয়োজনমতো ঢেলে সাজিয়ে এই শতকরা তিন ভাগ মানুষ শুষে খায় অন্য মানুষের অন্ন এবং শ্রম। নির্বিচার লুণ্ঠন চালায় দেশবাসীর সর্বজনীন সম্পদগুলোর ওপর। তাদের লুণ্ঠনের শিকার হতে হতে এক সময় বিলীন হয়ে যেতে থাকে এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল। নির্বিচার নিধন ঘটে বনসম্পদের। উচ্ছেদ হয় বনের গাছগাছালি এবং বনজীবী লাখ লাখ মানুষ। পনেরো কোটি মানুষের সম্পদ পাহাড়-টিলাগুলো পরিণত হয়ে যায় কয়েক হাজার মানুষের প্রমোদ-ভবনে। তেল-গ্যাস-কয়লাসহ সব খনিজসম্পদ বেহাত হওয়ার আশঙ্কা পরিণত হয় নিত্যদিনের দুঃস্বপ্নে। পুঁজিপতি তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রণোদনা জোগানোর নামে প্রাণদায়ী বাতাসে বিষ মেশানোর কার্যক্রমে নির্বিকার সহযোগিতা করে চলে রাষ্ট্র। এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যসব উপাদানের মতোই 'সম্মতি-উৎপাদন' বিষয়ে প্রভূত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলে গণমাধ্যমগুলো। তাই কখনোই জোরালোভাবে উচ্চারিত ও প্রচারিত হতে পারে না সেই প্রশ্নটি_ বাংলাদেশ কাদের জন্য অমিত সম্ভাবনার দেশ?
০৪.
তবুও যে বাংলাদেশ নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে সাহস পাই এখনও, তার কারণ_ মানুষ। ষোলো কোটি মানুষ। মানুষকে কখনও সংখ্যাতত্ত্ব এবং হিসাবের ফেরে বাঁধা যায় না। মানুষ চিরকালই অঙ্কশাস্ত্রের কাছে রহস্যই থেকে যাবে। বাংলাদেশের মানুষও প্রচলিত রাষ্ট্রশক্তি এবং করপোরেট মোড়লদের কাছে এক বিরাট রহস্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। বলা যেতে পারে, দাঁড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। তাদের কাছে যেটি রহস্য, আমাদের কাছে সেটিই শক্তি। সেই শক্তি এবং রহস্যময়তার একটি ব্যাপক রূপ দেখেছে বর্তমান পৃথিবীর মোড়ল-সমাজ। ১৯৭১ সালে সেই মোড়লদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকে স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে দিয়েই রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা এনেছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। চলি্লশ বছরে যতদূর যাওয়ার কথা ছিল, ততদূর যাওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পতাকার রঙ ফিকে করে দিয়েছে চূড়ান্ত অমানবিক বৈষম্য। কিন্তু স্বাধীনতার ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে আনার যুদ্ধে মানুষ ঠিকই ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই বিশ্বাসে শক্তি জোগায় একাত্তরই।

স জাকির তালুকদার :কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.