অন্তঃহীন যুদ্ধ-আফগান দুঃস্বপ্ন: কারমাল থেকে কারজাই by মশিউল আলম

আফগানিস্তানের যুদ্ধ সম্পর্কে উইকিলিকস যেসব গোপনীয় মার্কিন নথিপত্র প্রকাশ করেছে, তাতে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, ন্যাটোর নামে জোটবদ্ধ হয়ে মার্কিন সেনারা প্রায় ১০ বছর ধরে দেশটিতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কী ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে।

সর্বশেষ গত শনিবার দেশটির হেলমন্দ প্রদেশের নও জাদ জেলায় দুটি বাড়ির ওপর হেলিকপ্টার থেকে রকেট ছুড়ে মার্কিন মেরিন সেনারা হত্যা করেছে ১৪ জন নারী ও শিশুকে। তাদের মধ্যে পাঁচজন বালক, সাতজন বালিকা আর দুজন পূর্ণবয়স্ক নারী। হত্যাযজ্ঞ শেষ করার পর তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ভেবেছিল ওই দুটি বাড়িতে তালেবান জঙ্গিরা আশ্রয় নিয়েছিল। এর আগে, গত মাসের ১১ তারিখ ভোরবেলা কান্দাহার শহরে তারা একটি যাত্রীবাহী বাসের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করে চারজন বেসামরিক নিরীহ মানুষকে, গুলিবিদ্ধ করে জখম করে আরও ১৮ জনকে। তখন তারা বলেছিল, বাসটিতে তালেবান জঙ্গিরা যাচ্ছে ভেবে তারা তাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল।
আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর হাতে বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানির প্রায় প্রতিটি ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। কিন্তু মার্কিনদের পছন্দের লোক এই আফগান প্রেসিডেন্টের এসব প্রতিবাদপূর্ণ বিবৃতি প্রকাশে ন্যাটো বাহিনীর কিছুই এসে যায় না। তালেবানের ক্লান্তিহীন আক্রমণের মুখে তারা সব সময় এতই তটস্থ থাকে যে, নিজেরা মরার ভয়ে অন্যদের মারে। মে মাসের ২৫ তারিখে তালেবানের এক বোমা হামলায় একসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন আট মার্কিন সেনা। ২৬ তারিখে নিহত হয়েছেন দুজন ব্রিটিশ সেনা, একই তারিখে প্রাণ হারিয়েছেন আফগান পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, দুজন জার্মান সেনাসহ সাতজন। বিপরীত দিকে তালেবান জঙ্গিরাও হতাহত হচ্ছে অনেক। গত ২৪ মে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী নুরিস্তান প্রদেশে আফগান ও ন্যাটোর সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তালেবানের ২৮ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ২৪ জন।
আফগানিস্তানে প্রাণহানির সংখ্যার হিসাব দিয়ে দেশটির মানুষের দুঃস্বপ্নের চাপ পুরোপুরি অনুভব করা যাবে না। সুদীর্ঘ এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়ে গেছে দেশটির মানুষগুলো, সেই দুুঃস্বপ্ন যেন পরিত্রাণহীন, যেন এর কোনো অবসান নেই। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে দেশটির মার্ক্সবাদী সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য সোভিয়েত সেনাদের প্রবেশের আগে থেকেই রক্তপাত চলছিল। বাবরাক কারমালের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েতপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছিল মুজাহিদ বাহিনী। মুজাহিদদের অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মিসর, পাকিস্তান ও চীন। কারমাল সরকারের উপর্যুপরি অনুরোধে আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়েছিল ব্রেজনেভের সোভিয়েত সরকার। সোভিয়েতদের লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে, মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদতা থেকে বেরিয়ে আফগানিস্তান হবে একটি সমতাভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র। কিন্তু সেটা ঘটেনি। সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে ছিল নয় বছর। মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ওই সময়ে ১০ লাখের বেশি আফগান প্রাণ হারায়, দেশ ছেড়ে চলে যায় প্রায় এক কোটি মানুষ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, উল্টো গড়ে উঠেছে তালেবান গোষ্ঠী। ১৯৮৫ সালে গর্বাচভের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে পিরিস্ত্রোইকা শুরুর পর সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সোভিয়েত নেতৃত্ব বুঝতে পারে, আফগানিস্তানে সেনা পাঠানো ভুল হয়েছে। তারা সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৮ সালের মে মাসে তারা সেনা প্রত্যাহার শুরু করে, পরের বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রায় এক লাখের মতো সেনার সবাইকে স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়। তখন নজিবুল্লাহ সরকারের বিরুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীর লড়াই আগের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। নজিবুল্লাহ সোভিয়েতদের অনুরোধ করেছিলেন, তারা আর দুটো মাস যদি তাদের সহযোগিতা করে, তাহলে তাঁর সরকার টিকে যাবে। কিন্তু গর্বাচভ সে অনুরোধ রাখতে পারেননি। সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ তত দিনে গ্লাসনস্ত পেয়ে গেছে, তারা প্রকাশ্যেই বলা আরম্ভ করেছে: দেশে দেশে সমাজতন্ত্র রপ্তানি করার দরকার নেই, এবার আমরা নিজের চরকায় তেল দিই।
এখন আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা নেই, কিন্তু আছে মার্কিন সেনাবাহিনী, ন্যাটোর নামে ব্রিটিশ, জার্মান, অস্ট্রেলীয় সেনাবাহিনী। আফগানিস্তানে আজ ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লড়াই নেই; আছে ‘মুক্তি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাবরাক কারমাল নেই, আছেন হামিদ কারজাই। কিন্তু ব্যাপার রয়ে গেছে একই। মার্কিন বাহিনী প্রায় ১০ বছর ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করছে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার’ জন্য আফগান সরকারকে সামর্থ্যবান করে গড়ে তুলবে বলে। মার্কিনরা এর নাম দিয়েছে ‘আফগান নেশন-বিল্ডিং এফোর্ট’। সে জন্য তাদের আরও যা করতে হচ্ছে, তারা সেটির নাম দিয়েছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, আর পাকিস্তান মিলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে যে যোদ্ধাবাহিনী গড়ে তুলেছিল, আজকের তালেবান ও আল-কায়েদা তাদেরই উত্তরসূরি। তারা সোভিয়েতদের ‘সমাজতন্ত্র’ রপ্তানি ঠেকাতে যেভাবে লড়েছিল, আজ মার্কিনদের ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র’ রপ্তানি প্রতিহত করতে লড়ছে তার চেয়েও বেশি তীব্রভাবে।
১৯৮৮ সালের ১৫ মে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করার চার দিন আগে ১০ মে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি তার সদস্যদের উদ্দেশে একটি ‘গোপন চিঠি’ লেখে। সেই চিঠির এক জায়গায় লেখা হয়: ‘[আমরা যখন আফগানিস্তানে প্রবেশ করি], তখন দেশটির প্রকৃত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা যথেষ্ট পরিষ্কার ছিল না। আমরা বলতে চাই না, কিন্তু আমাদের বলা উচিত যে, ওই দুর্গম দেশটির অনন্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও আমাদের সঠিক ধারণা ছিল না।...উপরন্তু আমরা দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছি, সর্বোপরি এই সত্য অগ্রাহ্য করেছি যে, যখনই কোনো বিদেশি শক্তি অস্ত্র হাতে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছে, স্থানীয় জনগণ সর্বদাই অস্ত্র হাতে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। অতীতে তাই ঘটেছে, আমাদের বাহিনী যখন সে দেশে গিয়েছে তখনো তাই ঘটেছে...যতই সৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সেখানে গিয়ে থাকি না কেন।...স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা সামরিক পন্থাকেই সর্বোত্তম সমাধান মনে করেছিলাম, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিবিপ্লব দমন করতে চেয়েছিলাম। আমাদের প্রতি স্থানীয় জনগণের যে বিরূপ মনোভাব ছিল, তা মোচনের সুযোগগুলোও আমরা ঠিকমতো কাজে লাগাইনি...।..আমরা যে জীবনধারায় অভ্যস্ত, আমাদের লোকেরা আফগানিস্তানের মাটিতে তাই চালু করার চেষ্টা করেছে, স্থানীয় জনগণকে তারা উৎসাহিত করতে চেয়েছে আমাদের জীবনধারা অনুসরণ করতে। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়নি...।...সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মনে করে, আমাদের গোপন করার অধিকার নেই যে [আফগানিস্তানে] আমাদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল...নিহত হয়েছে আমাদের সর্বমোট ১৩ হাজার ৩১০ জন, আহত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৭৮ জন, তাদের অনেকেই পঙ্গু হয়েছে, নিখোঁজ হয়ে গেছে ৩০১ জন। যুক্তিসংগত কারণেই বলা হয়, একজন মানুষ এক অনন্য পৃথিবী; মানুষটি যখন মারা যায়, তখন সেই পৃথিবীটাই হারিয়ে যায় চিরতরে। একজন মানুষকে হারানো অতি বেদনাদায়ক এবং অপ্রতিকার্য...। আর স্বাভাবিকভাবেই আফগানদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি..।’
সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ যুদ্ধমুক্ত এক শান্তিময় পৃথিবীর স্বপ্ন থেকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্নের কী দশাই না করেছে আমেরিকা! গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গর্বাচভ বলেন, ব্রেজনেভের আমলে সোভিয়েত বাহিনী যখন আফগানিস্তানে প্রবেশ করে, তখন যুক্তরাজ্য প্রবল বিরোধিতা করে বলেছিল, আফগানরা একটা বিশেষ জাতি, বিশেষ ধরনের রীতিনীতি, আচার-প্রথা দ্বারা তাদের সমাজ চলে। বাইরে থেকে গিয়ে জোর করে তাদের সেইসব রীতিনীতি বদলে দিয়ে নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা ভুল। কিন্তু এখন ব্রিটিশরা নিজেদের সেই যুক্তি নিজেরাই মানছে না। ক্যামেরন সরকারকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গর্বাচভ আফগানিস্তান থেকে ব্রিটিশ সেনাদের প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান।
কিন্তু ডেভিড ক্যামেরন গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছেন, ব্রিটিশ সেনাদের আফগানিস্তান থেকে তিনি ফিরিয়ে নেবেন না। তবে, মার্কিন কংগ্রেসে গত শনিবার দুজন রিপাবলিকান ও একজন ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি এক যৌথ চিঠি লিখেছেন: তাঁরা বলছেন, ওসামা বিন লাদেন আর নেই, এখন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা উচিত। কিন্তু এ তো মাত্র তিনজন কংগ্রেসম্যানের মত। সেই দিন কি আসবে, যখন মার্কিন কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য সোভিয়েতদের মতো করে উপলব্ধি করবেন, আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়ে আমরা ভুল করেছি?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.