ক্লাসঘরের কথা : ২-ড. জেকিল ও মি. হাইড by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

(পূর্বপ্রকাশের পর) দেশের আইনের মধ্যেও এই চুক্তির প্রতিফলন হয়েছে। আইন বলছে : 'না বলে কারো কিছু নেওয়াকে চুরি করা বলে'। এর জন্যে শাস্তির বিধান আছে। অর্থাৎ সামাজিকভাবে আমরা যে মূল্যবোধগুলোতে বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের সংবিধানের আওতায় সেগুলোকে আইন হিসেবে, বিধি হিসেবে সংগ্রথিত করা হয়েছে। ব্যক্তি বা সমাজের মূল চাওয়া

একটাই- সুখী হওয়া। এখন আমি যদি না বলে তোমার প্রিয় কলমটি নিয়ে যাই, তুমি আমার প্রিয় বইটি নিয়ে যাও, সে তার প্রিয় জুতোটা নিয়ে যায়, ওরা অন্যদের আর অন্যেরা ওদের সবকিছু নিয়ে যায় তাহলে তো সবাই অসুখী হয়ে পড়ব। তাই সমাজ শর্ত করেছে, না বলে কেউ আমরা কারো কিছু নেব না। এরই নাম সামাজিক ন্যায়বোধ। এর অন্য নামই ঈশ্বর। একে মান্য করা মানে ঈশ্বরকে মান্য করা। ঈশ্বর মানে সামাজিক কল্যাণ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের সুখের এই ইচ্ছা ও সম্ভাবনাকে যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় সে হলো শয়তান। এভাবে আমাদের সুখ-দুঃখের প্রতীক হিসেবে ঈশ্বর আর শয়তানকে পেয়ে যাওয়ায় ভালো কী, খারাপ কী- এটা বুঝতে আজ আর কারো অসুবিধা হয় না। আমরা স্বচ্ছন্দে বলে দিতে পারি : যা অধিকাংশের জন্যে সুখের, তাই ভালো। যা অধিকাংশের জন্যে দুঃখের তাই খারাপ। কাজেই মানুষের সুখ বা ভালোর যা প্রতীক তাকেই আমরা নাম দিয়েছি ঈশ্বর, যা মন্দ তার নাম শয়তান। এখন বলো, এই দুয়ের মধ্যে আমাদের কাছে কে বেশি জরুরি। সুখ না দুঃখ? ঈশ্বর না শয়তান। নিশ্চয়ই ঈশ্বর। কেননা তার নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা মানেই তো আমাদের সুখ। সে জন্যেই বিশ্বচরাচরের সবচেয়ে উঁচু আসনটি সবাই তাঁকে দিয়েছে। কিন্তু এতসবের পরও শয়তানের অশুভ থাবা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। আমরা কত প্রার্থনা করি, আল্লাহ শয়তানকে দূরে সরিয়ে দাও। তোমার কাছে আমাদের আত্মসমর্পিত কর। কিন্তু শয়তান থেকে থেকেই আমাদের জীবনের কালো গহ্বর থেকে মুখ বের করে। সবার এত প্রতিরোধের পরও সে মরে না। মরে না কারণ, আগেই বলেছি, শয়তানও আসলে গডই। শয়তান না থাকলে গডের প্রয়োজনীয়তাই হয়তো ফুরিয়ে যেত। ঈশ্বরের মৃত্যু হতো।
যেকোনো সভ্যতার প্রথম পর্বে আমরা দেখি নির্মাণের আকুতি। মানুষ তখন মূলত চলে বিচার-বুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান আর পরস্পরের জন্যে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা দিয়ে। মানুষের ভেতরে যে অমঙ্গল বা ইভল আছে, এক কথায় তার ভেতরটায় যে ব্যক্তিগত স্বার্থলিপ্সু মানুষটি আছে তাকে পরাজিত আর শৃঙ্খলিত করে মানুষ তখন চেষ্টা করে কল্যাণময় সমাজ দাঁড় করাতে। ব্যক্তির চাইতে সমাজের হিতাকাঙ্ক্ষা সে সমাজে বড় হয়ে ওঠে। এই সমাজে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব তাই প্রায় নিরঙ্কুশ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই সমাজ এক সময় পাল্টে যায়। সমষ্টির হিতকে নিচে ফেলে আবার সেই ব্যক্তির হিত ওপরে উঠতে থাকে। বাড়তে থাকে ইভলের প্রতাপ। আত্মবিশ্বাসী মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার তলা থেকে আবার জেগে ওঠে সেই নিষ্কৃতিহীন শয়তানের মুখ, তার ভেতরকার সেই আদিম সরীসৃপ সত্তা। কেবল তার প্রতাপই যে বাড়ে তা না, সে প্রতাপের উপজাত হিসেবে সে যুগের দর্শন, বিজ্ঞানও একে সহযোগিতা করতে থাকে। ইয়োরোপে শিল্পবিপ্লবের পর যখন ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পেতে শুরু করল, যখন মানব-দরদিদের আর্তি ব্যর্থ কণ্ঠে বলতে লাগল : 'সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে', সেই সময় ডারউইন এসে বললেন, মানুষকে তোমরা কেন দেবতা বানাচ্ছ? তাকে কেন আশরাফুল মাখলুকাত বলছ? আসলে মানুষ তো বানরবংশীয় একটা প্রাণী মাত্র, বুদ্ধিমান পশু। তার জন্মের মহিমাকে অত গৌবান্বিত করার মানে নেই। তার মহত্ত্ব অন্য জায়গায়। সে বড় তার নিজ দায়িত্ব গ্রহণের শ্রেষ্ঠত্বে। ডারউইনের তত্ত্ব প্রকাশের পরের ৪০ বছর গোটা ইয়োরোপ ছিল টালমাটাল অবস্থায়। সংশয়ে আর দ্বন্দ্বে উথাল-পাতাল। সবার ভেতর আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। আদমের মতো এও তার এক ধরনের স্বর্গ থেকে পতনের যুগ। ডারউইনের প্রমাণকেও ওরা বাদ দিতে পারছে না, আবার গ্রহণ করতে গিয়েও নিজের ক্ষুদ্রতায় আর্তনাদ করে উঠছে। এতদিন সে জেনে এসেছে সে ঈশ্বরের অংশ : অমৃতস্য পুত্রা। একদিন স্বর্গের অমৃতলোকে ঘটবে তার প্রত্যাবর্তন। কিন্তু এখন এ কী শুনতে হচ্ছে তাকে? ডারউইন তবু পশু বলেই মানুষকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফ্রয়েড এসে যা বললেন তা আরো ভয়াবহ। তিনি জানালেন মানুষ কেবল জৈবিক পশু নয়, যৌন পশু। তার সমস্ত কর্মকাণ্ড লিবিডোর সুতোয় গাঁথা। এসবের ফলে সেকালে মানুষ নিজেকে খুঁজে পেয়েছে অনেক নিচু এক অবস্থানে। পুঁজিবাদের পথ ধরে, সমষ্টিকে হটিয়ে, ব্যক্তিমানুষ ক্রমে জায়গা দখল করে নিয়েছে পৃথিবীর। ঈশ্বরকে হটিয়ে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছে শয়তান। এমনি এক পটভূমিতে লেখা এই বই : ড. জেকিল ও মিস্টার হাইড। তাই এখানে ইভলের এতো আধিপত্য। ড. জেকিলকে হটিয়ে মিস্টার হাইড এ বইয়ে জয়ী। ড. জেকিল তাঁর নিজের পরাজয়ে দূরপনেয় রকমে দুঃখী, যন্ত্রণাবিদ্ধ। কিন্তু নিরুপায়। কারণ তাঁর যুগ মিস্টার হাইডের পক্ষে। কাজেই এই বইয়ের বিধিলিপি হয়ে উঠেছে ইভল, অমঙ্গল, যার অন্য নাম মিস্টার হাইড। সব মানুষের মতো এই চরিত্রটির মধ্যেও রয়েছে দুটি বিপরীত মানুষ- ড. জেকিল ও মিস্টার হাইড। একজন ঈশ্বর ও একজন শয়তান। এখানে কেউ হাইডকে চাচ্ছে না, সবাই প্রতিরোধ করছে, তবু শয়তান জয়ী হচ্ছে। পৃথিবীতে শিল্পীরা, লেখকরা হলেন সবচেয়ে সংবেদনশীল, স্পর্শকাতর মানুষ। বাস্তব জগতের যেকোনো পরিবর্তন সবচেয়ে আগে তাঁরা টের পান। লেখক স্টিভেনসনও বুঝতে পেরেছেন তাঁর যুগ পাল্টে গেছে। মূল্যবোধ পতিত হয়েছে। অমঙ্গল মঙ্গলের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করছে। খারাপ টাকা ভালো টাকাকে খেদিয়ে দিচ্ছে। এই বাস্তবতাটিকে লেখক এই বইয়ে প্রতীকায়িত করেছেন। তাই এ আমাদের কালের একটি চিত্তাকর্ষক গল্প কেবল নয়, এ আমাদের যুগের মহাকাব্য।
অনেক কষ্ট-শ্রমের বিনিময়ে মানুষ তিল তিল করে তৈরি করেছে সভ্যতা। যেখানে বড়সড় একপাত্র পানিতে এক ফোঁটা বিষ পড়লে সেই পানি নষ্ট হয়ে যায়, সেখানে মানবজাতির বিশাল পাত্রকে বিষহীন করে রেখে সভ্যতা গড়ে তুলতে হয়েছে মানুষকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না কী দুরূহ এই কাজ। প্রতিমুহূর্তের কী আমরণ সংগ্রামের ফল। এত পাপ মানুষের ভেতর, তবু সব উজিয়ে আজো মানুষ ঈশ্বরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে সভ্যতাকে, মানুষের সুখী হওয়ার আকুতিকে। কেন সমাজতন্ত্র এত চেষ্টা করেও পুঁজিবাদকে পরাজিত করতে পারেনি? কারণ প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থের যোগফলই হলো ক্যাপিটালিজম। পৃথিবীর এত মানুষের লোভকে কি কোনো রাজনৈতিক দল পরাজিত করতে পারে? তবু মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি যেহেতু তার ব্যক্তিগত লোভের চেয়ে প্রবলতর তাই আমার ধারণা এই সংঘাতে মানুষের টিকে থাকার আকুতিই জয়ী হবে। অর্থাৎ বিশ্বের সুস্থতার স্বার্থে পুঁজিবাদ নিজেকে সীমিত করতে বাধ্য হবে। এক কথায়, জিতবে মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি যার অন্য নাম ঈশ্বর। কিন্তু যুগের কারণে এই বইয়ে মি. হাইড জয়ী হয়েছে, ঈশ্বর পরাজিত হয়েছে। কিন্তু জেকিলের আত্মহত্যা বলে দেয় ঈশ্বর পরাজিত হলেও মরেনি। আমাদের ভাবতে অসুবিধা নেই : কোনো অদূর পৃথিবীতে- হয়তো শ খানেক বছরের মধ্যে মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি আবার জয়ী হয়ে ফিরে আসবে। মানুষের অস্তিত্বের গরজেই সে ফিরবে। মানুষের দিকে তাকিয়ে সহজেই আমরা তখন উচ্চারণ করতে পারব : 'ব্যাপ্ত হোক জীবনেরও জয়,/ ব্যাপ্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিষ্ময়।'
(সমাপ্ত)

No comments

Powered by Blogger.