ছয় ছাত্র হত্যা-আত্মঘাতী ‘সামাজিক ক্রসফায়ার’ by ফারুক ওয়াসিফ

ক্যাবলার চর তখন নিদাগ, হত্যাকাণ্ডের কোনো চিহ্নই নেই। যে বেড়ার চালাটার পাশে পেটাতে পেটাতে সাতজনের মধ্যে ছয়জনের জান বের করা হয়েছিল, শুধু সেখানটার নরম বালুতে অনেক পায়ের ছাপ, ছেঁড়া দড়ি, ভাঙা লাঠি। পাশেই তুরাগ নদে গান বাজাতে বাজাতে বালুবাহী ভলগেট যাচ্ছে, ড্রেজারের শব্দ।

আধা কিলোমিটার দূরে গাবতলী সেতু দিয়ে গাড়ি চলে, সভ্যতাকে সচল দেখা যায়। সেতুর পেছনে দূরে মিরপুরের দালানকোঠার সারি, এদিকটায় মোহাম্মদপুর-দারুস সালাম এলাকার পেছনটাও চোখে পড়ে। এসব এলাকা থেকেই ওই সেতু দিয়ে সভ্যতা পেরিয়ে সাত বন্ধু এসেছিল ‘অপরাধের আখড়া’, ‘মাদকের সাম্রাজ্য’, ‘অবৈধ ব্যবসার কেন্দ্র’, ‘নৈরাজ্যের স্বরাজ’ আমিনবাজারের বরদেশীতে। পথে পড়েছিল বালুর ঢিবি আর তার ওপরে বানানো বেড়ার গদিঘরগুলো।
সে রকম এক গদিঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বালু ব্যবসায়ী আবদুল খালেক। নিহত ছয় ও জীবিত একজনের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা তিনিই করেছেন। মঙ্গলবার তিনি ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন, আজ (বুধবার) ঘুরে বেড়াচ্ছেন মহল্লায়, এসে বসছেন গদিঘরে, শ্রমিকদের ফরমায়েশ দিচ্ছেন। বরদেশী মহল্লায় আর তার পেছনের এই বালুমহালে দৃশ্যত আজ সব স্বাভাবিক। এখান থেকে দেখা ঢাকা মহানগরও স্বাভাবিক।
কিন্তু কিছুই স্বাভাবিক নয়। ২০ জুন বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা। মহল্লার চিপা গলিতে সেদিন মানুষ কম। এলাকায় ঢোকার মুখে দুই সারি দোকান, তার একটা আবার সেলুন। সেখানে বসেই সাংবাদিক-র‌্যাব-পুলিশ সামলাচ্ছেন এলাকার মুরব্বিরা। গ্রামজুড়ে সাদা পোশাকে র‌্যাব-ডিবি। মোড়ে মোড়ে টিভি ক্যামেরা ঘিরে স্থানীয় মানুষ। সবারই একটা কথা, ‘অরা যদি ডাকাইত না হইব, তাইলে অত রাইতে ওইখানে কী করতে গেছিল?’ একই কথা সাবেক স্কুলশিক্ষক নব্য ভূমি ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন মাস্টার, আন্তজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মো. আসাদুল্লাহ এবং শ্রমিকনেতা ইসমাইল হোসেনের মুখেও। এলাকার লোকের মনোবল চাঙা রাখতে তাঁরা সদাব্যস্ত। বাইরের নিন্দা আর গণগ্রেপ্তারের ভয়ে তটস্থ পুরো এলাকা। এ অবস্থায় পুলিশই তাদের সহায়। তাদের মর্জিমতো ডাকাতির গল্প প্রচার করে পুলিশকে বাঁচাচ্ছে, বাঁচাতে চাইছে নিজেদেরও। সেখানে ভিড় করা মানুষের মধ্যে হাজি সাহেব, ছাত্র, দোকান কর্মচারী, ব্যবসায়ী—সবারই এক জবান, ঘটনার রাতে সবাই ছিলেন এলাকার গোরস্থানে। মাইকে ডাকাত খেদানোর ঘোষণা শুনে সবাই ছুটে ক্যাবলার চরে গেলেও, সেই ‘সবাই’ কারা তাঁরা তা জানেন না।
মামলাকারী বালু ব্যবসায়ী আবদুল খালেকও জানেন না, কাদের হাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছয়টি প্রাণ গেছে। কিন্তু অত রাতে সবাই যখন মসজিদে কিংবা গোরস্থান জিয়ারতে ব্যস্ত, তখন কেন তিনি গদিঘরে এসে ক্যাশবাক্সে পাঁচ হাজার টাকা রেখেছিলেন? কোনো সদুত্তর নেই তাঁর। বললাম, ডাকাতদের তো আপনিই শুধু দেখেছিলেন, তাই না? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তাহলে আপনি শনাক্ত করে না দিলে অন্যরা কীভাবে বুঝল, এই ছাত্ররাই ডাকাত? আপনি ঘটনাস্থলে ছিলেন? সেলুনে বসে তাঁর উত্তর ছিল, ‘আমি পরে গেছি, গিয়া দেখি সবাই মৃত।’ দুপুরে সেই গদিঘরে বসে বলেন অন্য কথা, ‘একটু আউগাইয়া আর যাই নাই।’ নিহতদের চেহারা না দেখেই তিনি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দিলেন, পুলিশ সেই মামলা নিল এবং প্রচার করল কুখ্যাত ডাকাত-কাহিনি!
হত্যাকাণ্ডটি গ্রামবাসী করলেও অন্তত দুজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের চোখের সামনে। অর্থাৎ এই ‘সামাজিক ক্রসফায়ার’-এর অনুমোদন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকেই এসেছে। স্থানীয় এক যুবকের ভাষ্য, বর্ষায় নদী ভয়ংকর হয়ে ওঠে। নদীপথে এবং নদীতীরের বসতিতে ডাকাতি বেড়ে যায়। এ মাসেও দুটি ডাকাতি হয়। গত বর্ষায় বরদেশীর উল্টো দিকের বিনোদবাড়ী-পাঁচগাছিয়ায় গণপিটুনিতে চারজন ‘ডাকাত’ নিধন করা হয়েছিল। এদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই। ক্রমাগত ডাকাতির মুখে আতঙ্কিত গ্রামবাসীকে নিরাপত্তা না দিয়ে তাদের আইন হাতে তুলে নেওয়ার এই পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় কাদের? আজ পুলিশ ভালো, প্রশাসন দায়িত্বশীল, ‘ভিলেন’ কেবল গ্রামবাসী? এটি পুরো সত্য নয়।
সব মহানগরেই সভ্য-সুন্দর-শান্তিপূর্ণ অভিজাত ও মধ্যবিত্ত এলাকা থাকে। তার বিপরীতে থাকে নগরসভ্যতার সীমান্তে ‘অপরাধপ্রবণ এলাকা’। কিন্তু শান্তিপূর্ণ অভিজাত এলাকায় অপরাধ কি কম? সেখানে বসে কি ‘অসভ্য’ বস্তি এলাকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শাসন চলে না? আইনের হাত এখানে পৌঁছায় না, তা নয়। বরং আইন স্থগিত থেকে এসব এলাকাকে অপরাধের অভয়ারণ্য করে রাখে। তাদের রাষ্ট্রের মধ্যে আলাদা রাষ্ট্র হয়ে উঠতে দেয়। তখন তাদের ব্যবহার করা হয় মাদক-অস্ত্র-দখলবাণিজ্য ও রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে। আর যখন তারা সংঘবদ্ধভাবে আইন হাতে তুলে নেয়, তখন তাদের বানায় ভিলেন। কিন্তু যাদের মনে হচ্ছে ভিলেন, তারা আসলে এক আত্মঘাতী বিপর্যয়ের বার্তাই বহন করছে, যে বার্তাটি তারা নিজেরা পড়তে অক্ষম। তাই তারা সত্য গোপন করছে, তারা বলতে পারছে না যে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল, আমরাই ‘খুন’ করেছি, অমানুষিক আতঙ্কে আমরা তখন আর মানুষ ছিলাম না। ভীত মানুষের থেকে ভয়ংকর কেউ হয় না। আমাদের বিচার করবে করো, কিন্তু আমাদের নারী-শিশুদের সাহস দাও, মানুষ হতে দাও, ফিরিয়ে দাও আমাদের মনুষ্যত্ববোধ।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ হিসাব দিচ্ছে, এ বছরেরই জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৭৫ জনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিটিয়ে মানুষ মারার ঘটনা ঘটেছে ১২৬টি। লিমন যেমন ক্রসফায়ারের একমাত্র নিরীহ শিকার নয়, গণপিটুনিতে নিহত শত শত মানুষের সবাইও অপরাধী নয়। অপরাধী হোক বা না হোক, পিটিয়ে হত্যা বা ক্রসফায়ারই যদি বিচারের বিকল্প হয়, তাহলে আইন-আদালত-সংবিধানের কী কাজ? আর সব জায়গার মতো বরদেশীতে দুষ্কর্মও যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সমাজবদ্ধ মানুষের সংসার। দুটোকেই একসঙ্গে দেখা দরকার। শহরতলিকে চরম অশুভ, আর মধ্যবিত্ত পাড়াকে পরম শুভ বলছি কিন্তু আমরাই, যারা সীমানার এপারে বাস করি।
কিন্তু সভ্যতার সীমান্তে যাদের বাস, তাদের কাছে রাষ্ট্র-পুলিশ-আইন ওল্টানো চেহারায় হাজির হয়। তারা এসবের ওপর আস্থাও হারায়, আবার ফাঁকি দিয়েচলতে অভ্যস্ত হয়। তারা তখন এলাকাগত ঐক্য গড়ে তোলে, চালায় নিজস্ব পাহারাদারি। ওপরের ক্ষমতাবানদের মদদ আদায়করে নিচের প্রান্তিক মানুষকে বশেরাখা হয়। অপরাধ আর আইন সেখানে এমনভাবে মেশামেশি হয়ে যায় যে আইনকে বহিরাগত মনে হয়, আর অপরাধী হয়ে ওঠে রক্ষক। সেই রক্ষকদের হাতেই ক্যাবলার চরে খুন হয়েছে আমাদের মানবতা। হত্যার শাস্তি হত্যাকারীরা পাক, কিন্তু এ অবস্থা যাদের দোষে তৈরি, তাদের কী হবে?
ছয় ছাত্রের জীবনের সঙ্গে মিশে ছিল এসব ভয়াবহ সত্য। সেদিন কেবল ছয়টি প্রাণ ঝরে যায়নি, নিহত হয়েছিল আমাদের বুদ্ধি ও বিবেক, সত্য ও মানবতা। তাই ছাত্রদের পরিচয় হয়েছে ডাকাত, পুলিশ হয়েছে উত্তেজিত গ্রামবাসীর বন্ধু আর ভীত গ্রামবাসী আপন কর্মদোষে গুষ্টিসুদ্ধ হয়ে গেছে ‘অপরাধী’। এ অবস্থায় ‘তারা’ ও ‘আমরা’ নৈরাজ্যের ক্যাবলার চরে ক্যাবলা হয়ে আছি।
ছাত্র হত্যা কিংবা ছাত্রদের ডাকাত প্রমাণের চেষ্টা অহরহই চলে। কারণ, সত্যবাদী, সৎ ও সংগ্রামী বলে ছাত্রসমাজের যে পরিচয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ছিল, তার সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার বিচ্ছেদ ঘটেছে। কতিপয় ছাত্রদের সন্ত্রাসী-নেশাখোর-বেয়াড়া বানিয়ে ছাত্রত্বের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করা হয়েছে। তাই সহজেই ছাত্রদের ডাকাত-সন্ত্রাসী-নেশাখোর বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা পুলিশ বা অন্য কেউ করতে পারে। বরিশালের লিমন থেকে শুরু করে ঢাকার ছয় ছাত্রের বেলায় এটাই দেখি। লিমনের কাটা পা আর ছয় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যে তাই গোটা সমাজ বাস্তবতারই পঙ্গুত্ব ধরা পড়ে। শোনা যায়, বাংলাদেশের চলমান নৈরাজ্য ও অমানবিকতার মধ্যে আটকা পড়া মানুষের হাহাকার। তখন সত্যের ভাষণ, বিচারের বাণী, মনুষ্যত্বসহ যা কিছুর ওপর সমাজটা দাঁড়িয়ে আছে, তার সবই ভেঙে পড়তে থাকে।
এক আদিম বর্বরতা সামাজিক-সভ্য-নিরীহ মানুষের মধ্যে ঘাপটি মেরে বাস করে, নৈরাজ্য থেকে জীবনীশক্তি টানে। আইন-নৈতিকতা-মনুষ্যত্ব—সবকিছুকে আছর করে টিকে থাকে তা। আইনকানুন-ব্যবস্থা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ দিয়ে তাকে বশে রাখতে হয়। কিন্তু ওই লাগামগুলো যখন চরম শিথিল হয়ে যায়, তখন আমরাই কেউ ভিলেন আর কেউ নায়কের বেশে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমাদেরই ওপর। আমরা হয়ে উঠি আত্মঘাতী। দাঙ্গার সময়ও দেখা যায়, মনের তলায় লুকিয়ে থাকা হিংসা-প্রতিহিংসা বিকট চেহারায় বেরিয়ে পড়ে। আমাদের নির্বিকার সহনশীলতা আর বিকারগ্রস্ত প্রতিরোধ—দুটোই তখন আমাদেরই বিরুদ্ধে চলে যায়।
এ অবস্থায় আমরাই আমাদের শিশুদের মৃত্যুর ট্রাকে উঠিয়ে দিই, তুলে দিই ধর্ষক শিক্ষকের হাতে, গণপিটুনিতে হত্যা করি আদরের টুকরোদের এবং রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমা করে দিই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে। এসব দিনরাত্রি কি তাহলে আত্মঘাতের খাদ কাটারই ইতিহাস? গা ছমছম করা ক্যাবলার চর কি জাগছে না সমাজের বুকের ওপর, আমাদের বসতির মাঝখানে? তা কি নয় সভ্যজগতেরই অন্ধকার অন্দরমহল? যেখানে গেলে কেউ আর ফেরে না! ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, ক্যাবলার চরটা ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশময়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.