গণমাধ্যম-বিলেতি সাংবাদিকতার স্বশাসনের সংকট by মশিউল আলম

রুপার্ট ও জেমস মারডকের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের সাংবাদিকতার কোনো ক্ষতি হয়নি। পত্রিকাটি খুব জনপ্রিয় ছিল বটে, কিন্তু সাংবাদিকতার গুণগত মান, রুচিবোধ ও নৈতিকতার বিচারে ছিল নিকৃষ্ট। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশটির মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

প্রায় ৬০ বছর ধরে বিলেতের সংবাদমাধ্যম বেশ স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে। এই স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে প্রধানত রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের মধ্যে এমন মতৈক্যের ফলে যে সংবাদমাধ্যম হচ্ছে গণতন্ত্রের নার্ভাস সিস্টেম। ওই নার্ভাস সিস্টেমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া প্রয়োজন, নইলে গণতন্ত্র সুস্থ থাকবে না। তাই বিলেতে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠন করা হয়নি, সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান সংবাদমাধ্যমের ওপর ছড়ি ঘোরায় না। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের পথে কোনো সংবাদপত্রকে বাধা দিতে পারে—এমন কোনো আইন সে দেশে নেই। তবে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রয়েছে প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন (পিসিসি) নামের একটি স্বাধীন সংস্থা। ১৭ জন সদস্য নিয়ে গঠিত এই সংস্থার চেয়ারপারসনসহ ১০ জন নাগরিক সমাজের মানুষ, যাঁদের সঙ্গে সংবাদপত্রশিল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। বাকি সাতজন সাতটি সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে কর্মরত সম্পাদক। সরকারের সঙ্গে পিসিসির কোনো সম্পর্ক নেই—সরকার কোনো অর্থ দেয় না, কোনো সংবিধি দ্বারা একে নিয়ন্ত্রণও করে না। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনগুলোর দেওয়া বার্ষিক চাঁদার অর্থে এর ব্যয় পরিচালিত হয়। পিসিসি বিলেতের মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের তৈরি করা একটি আচরণবিধির ভিত্তিতে, যেটিকে বলা হয় ‘এডিটরস কোড অব প্র্যাকটিস’। এর মাধ্যমে পিসিসি চেষ্টা করে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকারগুলো রক্ষা করতে এবং একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের প্রকাশের যথাযথ স্বাধীনতা (অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশান) বজায় রাখতে।
কিন্তু নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পিসিসি ব্যর্থ হয়েছে। পত্রিকাটির মাত্র একজন রিপোর্টার দুই রাজপুত্রসহ প্রায় চার হাজার ব্যক্তির মোবাইল ফোনের ভয়েসমেইল হ্যাক করেছেন—অভিযোগটি এখন আর এইটুকু নয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উন্মোচিত হয়েছে বিলেতি ট্যাবলয়েড সাংবাদিকতার বিরাট অন্ধকার দিক। জনস্বার্থের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই—এমন সব বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের গুপ্ত, অশোভন, অনৈতিক ও বেআইনি অনেক পন্থা চালু রয়েছে লন্ডনের ট্যাবলয়েড-জগতে। কেবল মারডকের নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এই চর্চা, সবগুলো ট্যাবলয়েড পত্রিকার সাংবাদিকেরাই কমবেশি তা করেন। এ জন্য ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করে ‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর’ পোষে। সাংবাদিকেরা পুলিশের সদস্যদের ঘুষ দেন, পতিতাদের ব্যবহার করেন, নিজেরাও ছদ্মবেশ ধারণ করেন, ব্ল্যাকমেইল করেন, আদালতে চলমান মামলায় হস্তক্ষেপ করেন, পুলিশের অনুসন্ধানকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন, টাকা-পয়সা দিয়ে আদালতের বাইরে বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটিয়ে দেওয়ার দালালিও করেন। লন্ডনের ট্যাবলয়েড-জগতের সবাই এই পন্থাগুলোকে জানে ‘দ্য ব্ল্যাক আর্ট’ নামে। নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর সাবেক সম্পাদক অ্যান্ডি কুলসন, যাঁকে ৮ জুলাই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তিনি ছিলেন এই ‘ব্ল্যাক আর্ট’ প্রসারের একজন চ্যাম্পিয়ন। তাঁরই এক সাবেক রিপোর্টার নিউইয়র্ক টাইমস-এর তিন সাংবাদিককে বলেছেন, অসাধু পন্থায় তথ্য সংগ্রহের জন্য কুলসন তাঁর অফিসে রিপোর্টারদের মধ্যে একটা ‘হাইপার-কমপিটিটিভ’ মানসিকতা সৃষ্টি করেছিলেন।
এসব যখন প্রকাশ হয়ে পড়ল, বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল বিলেতের রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের লোকজনের মধ্যে। বিশেষত খেপে গেলেন রাজনীতিকেরা। লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড বললেন, ‘পিসিসি গঠন করা হয়েছিল পাহারাদার কুকুর হিসেবে (ওয়াচডগ)। কিন্তু সেটা পরিণত হয়েছে একটা দাঁতহীন পোষা কুকুরে (টুথলেস পুড্ল)।.. এখন আমাদের একটা নতুন ওয়াচডগ দরকার।’ এড মিলিব্যান্ডের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন সংবাদ সম্মেলন ডেকে বললেন, ‘...এটা এখন সবার কাছেই পরিষ্কার হয়েছে যে আমাদের সংবাদমাধ্যমের স্বশাসনব্যবস্থা আর কাজ করছে না।...প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন ব্যর্থ হয়েছে।...পিসিসি অকার্যকর হয়ে পড়েছে...। এ কথা বলার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে পিসিসি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বিরোধাত্মক। কারণ এর আওতায় পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্রগুলো পরস্পরকে বিচার করছে। তাই এই সংস্থা জনগণের আস্থা হারিয়েছে। আমার মনে হয়, আমাদের সম্পূর্ণ নতুন একটি ব্যবস্থা প্রয়োজন।...সেই ব্যবস্থাকে হতে হবে প্রকৃতই স্বাধীন...সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে স্বাধীন, ...যেন সংবাদপত্রগুলো আর কখনোই এমন সুযোগ না পায় যে কেবল তারা নিজেরাই নিজেদের আচরণের তদারকি করবে [আর কেউ নয়]।’ সেদিনই প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন তাঁর দেশবাসীকে জানিয়ে দেন যে সংবাদমাধ্যমের নতুন একটি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা (রেগুলেশন সিস্টেম) প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি ইতিমধ্যে তাঁর উপপ্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।
অর্থাৎ বিলেতের সংবাদমাধ্যমের স্বশাসনের দিন বুঝি শেষ হয়ে এল। এ রকম নাজুক পরিস্থিতি আর একবার সৃষ্টি হয়েছিল গত শতকের আশির দশকের শেষ দিকে। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ প্রেস কাউন্সিল ভেঙে দেওয়া হয়েছিল তখন। কারণ, কতিপয় সংবাদপত্র সাংবাদিকতার উচ্চ নৈতিক মানদণ্ড রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। প্রেস কাউন্সিল জনগণের ও রাজনীতিকদের আস্থা হারিয়েছিল। পার্লামেন্টের সদস্যরা তখন বললেন, এই প্রেস কাউন্সিল দিয়ে আর চলবে না। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে হলে এমন একটি প্রতিষ্ঠান দরকার, যার আইনি ক্ষমতা থাকবে এবং তা হবে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। কিন্তু ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠলে সরকার স্যার ডেভিড ক্যালকাট নামের একজন বর্ষীয়ান আইনজীবীর নেতৃত্বে একটি বিভাগীয় কমিটি গঠন করে বিষয়টি বিবেচনার দায়িত্ব সেই কমিটিকে দেয়। প্রায় এক বছর পর ১৯৯০ সালের জুনে ওই কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, আপাতত কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণ আরোপের দিকে না গিয়ে প্রেস কাউন্সিলের জায়গায় নতুন একটি সংস্থা গঠন করা যেতে পারে, যার নাম হবে প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন। সেই কমিশন সংবাদমাধ্যমে যথাযথ সদাচরণ ফিরিয়ে আনার জন্য ১৮ মাস সময় পাবে। এই সময়ের মধ্যে তাকে দেখাতে হবে যে সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থার বাইরে থেকেই সংবাদমাধ্যমের স্বশাসনের (সেলফ-রেগুলেশান) ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে ফলপ্রসূ করা সম্ভব। যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে আইনি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থা প্রবর্তন করার সুপারিশ করে ক্যালকাট কমিটির প্রতিবেদন।
এতে ব্রিটেনে সংবাদমাধ্যমের টনক নড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে সদাচরণ ফিরে আসে। ১৮ মাসের মধ্যেই পরিস্থিতির এমন উন্নতি ঘটে যে সরকারকে ক্যালকাট কমিটির শেষ সুপারিশটির কথা আর ভাবতে হয়নি। ১৯৯১ সালের শুরুতে প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন গঠিত হয়; জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনগুলোর সম্পাদকেরা মিলে প্রথমবারের মতো প্রণয়ন করেন একটি আনুষ্ঠানিক আচরণবিধি: ‘কোড অব প্র্যাকটিস’, যেটি এখন এডিটরস কোড অব প্র্যাকটিস নামে পরিচিত। সব সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের প্রকাশক ও সম্পাদকেরা ওই আচরণবিধি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন। সরকার ও পার্লামেন্টের সংশ্লিষ্ট সিলেক্ট কমিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে পিসিসির কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
আজ আবার সেই পিসিসি ভেঙে দিয়ে নতুন একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠার কথা উঠেছে। রুপার্ট মারডক স্টাইলের ট্যাবলয়েড সাংবাদিকতা যে বিলেতের দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য এমন বিপদ একদিন ডেকে আনতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেকের মধ্যেই ছিল। তাঁরা এই বিপদ মোকাবিলার চেষ্টা করছেন। আসলে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর ফোন হ্যাকিংসহ ট্যাবলয়েড-জগতের ‘ডার্ক আর্টে’র অশুভ চর্চার তথ্যগুলো ফাঁস করেছে বিলেতের দায়িত্বশীল সংবাদপত্রগুলোই। বিশেষ করে গার্ডিয়ান ও ইনডিপেন্ডেন্ট। মারডক গং বিলেতে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী; ফোন হ্যাকিংয়ের ঘটনা তাঁরা প্রায় ধামাচাপা দিয়েই ফেলেছিলেন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রাথমিক তদন্ত শুধু একজন রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ফোন হ্যাকিংয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে (তাও সেটা যুবরাজ হ্যারির ফোন হ্যাকিংয়ের কারণে)। পিসিসির প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ক্লাইভ গুডম্যান নামের ওই রিপোর্টার ছাড়া নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর আর কোনো রিপোর্টার ফোন হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত নন। কিন্তু এখন পিসিসিকে দুঃখ প্রকাশ করে ওই প্রতিবেদন প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে; পিসিসি এখন বলছে, নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের মিথ্যা বলেছিলেন। এ সবই সম্ভব হয়েছে গার্ডিয়ান, ইনডিপেন্ডেন্ট ও আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমস-এর নিরন্তর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চাপে। শেষ পর্যন্ত রেবেকা ব্রুকসকে নিউজ ইন্টারন্যাশনালের চিফ এক্সিকিউটিভের পদ ছেড়ে দিতে হয়েছে। মারডকের এই ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রধান ছিলেন লেস হিন্টন, যাঁর সময়েও ফোন হ্যাকিং হয়েছে বলে এখন খবর বেরিয়েছে, তিনি মারডকের অন্য প্রতিষ্ঠান ডাউ জোনস-এর প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, মারডকের ডান হাত বলে পরিচিত সেই লেস হিন্টনকেও মারডকের মূল প্রতিষ্ঠান নিউজ করপোরেশন থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
ইংরেজি ভাষাভাষীরা বলেন, ডগ ডাজনস ইট ডগ। বাংলায় আমরা বলি, কাক কাকের মাংস খায় না। কিন্তু বিলেত-আমেরিকায় খায় বৈকি। জনগণের আস্থাই সংবাদমাধ্যমের একমাত্র পুঁজি; সেই পুঁজি রক্ষা করতে হলে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে হয়। প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন যা পারেনি, গার্ডিয়ান ও অন্যান্য দায়িত্বশীল সংবাদপত্র তাই করার চেষ্টা করছে। ফলে মারডকের ‘মিডিয়া সাম্রাজ্য’ কেঁপে উঠেছে; ‘ডার্ক আর্ট’ ব্যবহারকারীদের টনকও নড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যখন প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন ভেঙে দিয়ে নতুন একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের কথা বললেন, গার্ডিয়ান তখন এক সম্পাদকীয়তে লিখল, ‘তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না।’ গার্ডিয়ান-এর কথায় যুক্তি আছে; রাজনীতিকেরা যতই খেপুন, ওই যুক্তি উপেক্ষা করতে পারবেন না।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.