নদীকৃত্য দিবস-বাঁধমুক্ত নদী আমাদের অধিকার

এবার ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস (ইন্টারন্যাশনাল ডে অব অ্যাকশন ফর রিভার্স) আমরা এমন সময় পালন করছি, যখন গোটা বিশ্ব, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার নদ-নদী বাঁধের ফাঁসে হাঁসফাঁস করছে। নদীর এই দুঃসময় বাংলাদেশ থেকে অনুধাবন করা সবচেয়ে সহজ।

আমরা দেখছি, এই বদ্বীপে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা প্রাণোচ্ছল নদীগুলো ক্রমেই সংকীর্ণ ও প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। নাব্যতা, মৎস্য সম্পদ, প্রতিবেশে জল সিঞ্চনের ক্ষমতা ও সৌন্দর্য হারিয়ে প্রাণপ্রবাহগুলো পরিণত হচ্ছে অশ্রুরেখায়। অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং নদী বৈরী তৎপরতাও এর জন্য দায়ী। কিন্তু মূল কারণ উজান থেকে পানি প্রত্যাহার। গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা এবং তিস্তায় গজলডোবা ব্যারাজ বসিয়ে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছিল দুই-তিন দশক আগেই। পরে মহানন্দার মতো আরও কয়েকটি নদীতে ব্যারাজ স্থাপিত হয়েছে। গত এক দশক ধরে উজানের নদীগুলোতে চলছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে আড়িবাঁধ স্থাপনের যজ্ঞ। আমরা জানি, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা অববাহিকার প্রত্যেকটি নদী কোনো না কোনোভাবে হিমালয়ের সঙ্গে যুক্ত। সেখানকার হিমবাহ ও বৃষ্টিপাতই এ দেশের শত শত নদীর চূড়ান্ত উৎস। সুউচ্চ ওই জলজ রাজ্যে শুরু হওয়া বাঁধের উৎপাত কী মাত্রায় পৌঁছেছে, কয়েক বছর আগে ইন্টারন্যাশনাল রিভার্স পরিচালিত একটি সমীক্ষায় তা দেখা গেছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিমালয় অঞ্চলে ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে আমাদের নদ-নদীর চূড়ান্ত সর্বনাশই হবে। সম্প্রতি ফের সামনে চলে এসেছে ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রশ্নটি।
নদীবিনাশী যে তিন ধরনের বাঁধ এই অঞ্চলে দেখা যায়, তার মধ্যে সংখ্যাগুরু হচ্ছে আমাদের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত টিপাইমুখ প্রকল্পের মতো জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী স্থাপনাগুলো। সড়ক ও রেল যোগাযোগের নামে কিংবা পানি প্রত্যাহার করে সেচ কাজের দোহাই দিয়ে যেসব বাঁধ ও ব্যারাজ নদীতে আড়াআড়িভাবে বসানো হয়, সেগুলো ব্যাপক সমালোচিত হলেও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বাঁধ নিয়ে এর সমর্থকেরা সাফাই গেয়ে থাকেন। মোটা দাগে বলে থাকেন, এতে পানি প্রত্যাহার হয় না বলে নদীর ক্ষতি নেই এবং জলবিদ্যুৎ হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। বাস্তবে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও নদীসহ পরিবেশ-প্রতিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর। নদীকৃত্য দিবস পালনের পথিকৃৎ ইন্টারন্যাশনাল রিভার্স এ বছর এই বিষয়ের প্রতিই জোর দিয়েছে। কেবল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বাঁধের পক্ষে সাফাই নয়, বিপুল এই বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীগুলো জাতিসংঘ ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যামসের (ডব্লিউসিডি) সুপারিশ অগ্রাহ্য করার জন্য নিজেরা কয়েক বছর আগে দ্য হাইড্রোপাওয়ার সাসটেইনিবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট প্রটোকল (এইএসএপি) নামে একটি প্রশ্নবিদ্ধ দলিল তৈরি করেছে। ইন্টারন্যাশনাল রিভার্স এক ফ্যাক্টশিটে দলিলটির পক্ষপাত, দুর্বল তাত্ত্বিক ভিত্তি ও অকার্যকারিতা তুলে ধরা হয়েছে। রিভারাইন পিপল (Riveৎine People) থেকে আমরা গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালন করে আসছি। ইন্টারন্যাশনাল রিভার্সের উদ্বেগের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এবার আমরা বাঁধমুক্ত নদীর দাবি তুলে ধরছি। তাই আমরা বলছি, ‘বাঁধ হঠাও, বিপর্যয় ঠেকাও’।
আমরা মনে করি, আজ নদীর কাছে জবাবদিহি করার দিন। আমরা জানি, বছরভর নদী তার পানি ও প্রতিবেশে আমাদের জীবন সচ্ছল রাখে। এর প্রতিদান আমরা কীভাবে দিই, আজ তার হিসাব-নিকাশের দিন। ১৯৯৭ সালে ব্রাজিলে কুরিতিবা শহরে এক সমাবেশ থেকে নদীর প্রতি দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দেওয়া এ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেখানে একত্র হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। তাইওয়ান, ব্রাজিল, চিলি, লেসোথো, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরাই ১৪ মার্চকে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশে আমরা নদীকৃত্য দিবস পালন করছি মূলত নাগরিক দায়িত্বশীলতা বাড়ানোর জন্য। আমরা মনে করি, নদীর প্রতি আমাদের সব সময়ই দায়িত্বশীল থাকা জরুরি। নদীবান্ধব নাগরিকই সর্বোত্তম প্রহরী। নদীকৃত্য দিবসের মাধ্যমে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নদী যেমন নিরন্তর তার সিঞ্চনে ও সম্পদে আমাদের উপকার করে যাচ্ছে, তেমনি আমাদেরও উচিত মাস কিংবা মৌসুমভেদে নদীর ব্যাপারে সচেতন থাকা। বহুমাত্রিক ব্যস্ততার এই যুগে নদীর প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে আলাদা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। বাংলাদেশে নদীকৃত্য দিবস পালনের মধ্য দিয়ে নদী সুরক্ষা আন্দোলন আরও বিস্তৃত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মনে রাখা জরুরি, উজানের দেশ থেকে নদীতে বসানো বাঁধের পাশাপাশি আমরা নিজেরা যেসব বাঁধ অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করছি তার ব্যাপারেও নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে। নদীকেন্দ্রিক মানুষের আর্থসামাজিক, সুখ-সমৃদ্ধি বহুলাংশে নির্ভর করে নদীর সহজাত নাব্যতার ওপর। আর এই সমস্ত নদীতে অপরিকল্পিত যেকোনো বাঁধই হোক না কেন তা ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য নিয়ে এসেছে ভয়াবহ পরিস্থিতি। এ প্রসঙ্গে আমরা বড়াল নদীর কথা বলতে চাই। বৃহত্তর রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এবং চলনবিলের প্রাণপ্রবাহ বলে পরিচিত এ নদীতে আমরা নিজেরাই একের পর এক বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণ করেছি। ফলে নদীটি পতিত হয়েছে মৃত্যুমুখে। অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কী করুণ পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে, তাও কারও অজানা নয়। এশিয়ার বৃহত্তম প্রাকৃতিক মৎস্যপ্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও নানা কারসাজি চলছে।
নদী সুরক্ষার যে বিশাল চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আরও বাড়তেই থাকবে, তা মোকাবিলা করতে হলে নাগরিক ঐক্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি জরুরি। এবারের নদীকৃত্য দিবস সেই তাগিদ জোরদার করুক।
লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং নদীবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ রিভারাইন পিপলের সঙ্গে যুক্ত।
ৎiveৎine.people@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.