প্রতিক্রিয়া-মানুষ অমানুষ নামানুষ by আহমেদ হেলাল

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কক্সবাজার সদর হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে ‘অনিয়ম’ দেখে ডাক্তাদের ‘অমানুষ ও রক্তচোষা’ অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। তাঁর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ, ৬ মার্চ প্রথম আলোয় তা প্রকাশিত হয়েছে।

৯ মার্চ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান তাঁর অবস্থান তুলে ধরে একটি লেখা প্রকাশ করেন প্রথম আলোয়। তারপর মশিউল আলম প্রথম আলোয় ১১ মার্চ লিখলেন ‘মানুষ চিকিৎসা নিতে “অমানুষ”দের কাছেই যাবে’।
মশিউল আলম সরলীকরণ করতে গিয়ে সব ডাক্তারকে বা তাঁর ভাষায় ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ ডাক্তারকে অমানুষ বলেছেন। একটি পেশার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ‘অমানুষ’ আর সেই পেশার কর্মতৎপরতায় ২০১০ সালে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘের মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন! আবার ২০১১তে একই সংস্থা থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অর্জন করেন ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড! অমানুষদের রক্তচোষা নীতির কল্যাণে একটি দেশ দু-দুবার জাতিসংঘের পুরস্কার পেল!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশে প্রতি এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে প্রতি ৩৯০ জনের জন্য একজন চিকিৎসক। আর আমাদের দেশে প্রতি চার হাজার জনের জন্য একজন। ১৬ কোটি মানুষের জন্য প্রায় ৫০ হাজার জন। এই ৫০ হাজার জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সরকারি চাকরি পান না, তাই সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তারপ্রতি রোগীর অনুপাত দ্বিগুণ হয়ে যায়। মশিউল আলমকে আমন্ত্রণ রইল, যেকোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাত দিন একজন অমানুষের আতিথেয়তায় থেকে দেখে যাবেন মাঠপর্যায়ে কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আউটডোরে বসা একেকজন চিকিৎসককে ছয় ঘণ্টায় গড়ে এক শর ওপরে রোগী দেখতে হয়। তার ওপর থানার ওসি সাহেবের কাজের মেয়েকে বাসায় গিয়ে দেখতে হবে, ছাত্রনেতা এসেছেন উপজেলা স্বাস্থ্যকর্তার রুমে, তার ঘাড়ে ব্যথার ওষুধ দিতে হবে, চেয়ারম্যান সাহেব একটি ইনজুরি সার্টিফিকেট চান, পত্রিকার বা চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিনিধি এসেছেন, সঙ্গে তাঁর নিজের লেখা অখাদ্য কবিতা বা নেতার জীবনীর বইয়ের ১০টি কপি নিয়ে; সেগুলো নাকি ডাক্তারদের কিনতেই হবে ইত্যাদি। এর প্রতিটিই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। এখন এই এত কিছু সামাল দিয়ে ছয় ঘণ্টায় ১০০ রোগী দেখতে গেলে প্রতি রোগীকে গড়ে কত মিনিট সময় দেওয়া যাবে? আর হাটবারের দিনে এই রোগীর সংখ্যা হয়ে ওঠে দ্বিগুণ।
সাধারণ মানুষের ‘ধারণা’ থেকে মশিউল আলমও ধারণা করেছেন, ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন নিয়ে থাকেন। মশিউল আলম যদি মাত্র দু-তিনজন ডাক্তারকে হাজির করতে পারেন যে তাঁরা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন গ্রহণ করেন, তবে তার বিপরীতে কমপক্ষে ৯৫ জন ডাক্তারকে হাজির করা যাবে; যাঁরা এই কমিশন গ্রহণ করেন না।
ডাক্তারের ভিজিট সম্পর্কে লিখেছেন তিনি। আয়কর দেন কি না, জানতে চেয়েছেন। ব্যক্তিশ্রেণীর শীর্ষ করদাতা ১০ জনের তালিকা প্রায় প্রতিবছর সব পত্রিকায় ছাপা হয়। বিগত কয়েক বছরে তার মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি থাকেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসকের শতকের ঘরের ভিজিট নিয়ে আহাজারি করেছেন মশিউল আলম, ৫০ জন করে রোগীর তালিকা দিয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশের সব চিকিৎসকের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন চিকিৎসকের এ ধরনের রোগী হয়ে থাকে, আর তাঁরাই কিন্তু শীর্ষ করদাতাদের মধ্যে রয়েছেন। বাকি অধিকাংশ চিকিৎসক কিন্তু অতি সাধারণ জীবন যাপন করেন।
মিজানুর রহমান আর আব্দুল্লাহ স্যারের লেখার পাঠক প্রতিক্রিয়ার কয়েকটি তিনি উল্লেখ করেছেন। যেগুলো চিকিৎসকদের হেয় করে সেগুলোই তিনি বলেছেন, অন্যগুলো নয়। বাকিগুলোতে কিন্তু চিকিৎসক ছাড়াও অনেকে মিজানুর রহমানের মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন।
মশিউল আলম চিকিৎসা পেশার সঙ্গে অন্য পেশার পার্থক্য শেখাতে চেয়েছেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহকে! মশিউল আলমকে অনুরোধ করব সাংবাদিকতার সব মেধা প্রয়োগ করে তিনি যেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ সম্পর্কে তিনটি বিষয় আমি উল্লেখ করতে চাই: ১. মশিউল আলমের লেখায় ডাক্তারদের ভিজিটের যে বয়ান করা হয়েছে, তার চেয়ে ওনার ভিজিট এখনো অনেক কম। ২. তিনি কোনো প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তাঁর রোগীর কোনো পরীক্ষা করাতে পাঠান না, তিনি পাঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩. এক-এগারোর পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেও তিনি বর্তমান সরকারের কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করেননি।
১৯৯৪ থেকে ২০১০—এই ১৬ বছরে চার গুণ বেশি ওষুধ বিক্রির সঙ্গে ডাক্তারদের লাভকে মিলিয়ে দেখার মতো একটি কাঁচা কাজ করেছেন জনাব মশিউল আলম। এই ১৬ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে কত, মানুষের আয় বা কর্মক্ষমতা বেড়েছে কত, নতুন ওষুধ এসেছে কতগুলো—সেসবও বিবেচনায় রাখতে হবে। তার ওপর অপচিকিৎসা কমে গিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার প্রসার বেড়েছে। ১৬ বছরে অর্থনীতির অবকাঠামোর বিরাট পরিবর্তন হয়েছে, সবকিছুর বিক্রি বেড়েছে। অন্য সবকিছুর মতো ওষুধের বিক্রি বেড়েছে, দেশে ওষুধ শিল্পের প্রসার ঘটেছে, দেশের বাজার ছাড়িয়ে বিশ্বের বহু দেশে আমাদের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। এই অগ্রসর শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ডাক্তারদের ‘অমানুষ’ বানানোর চেষ্টা যেন গরুর রচনা লিখতে গিয়ে গরুটিকে জোর করে নদীর কিনারে নিয়ে গিয়ে নদীর রচনা লেখার মতো হয়ে গেছে।
গত বছর ডিসেম্বরে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বাংলাদেশে এসে মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে এগিয়েছে, এখানে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে (বাসস ২৯ ডিসেম্বর, ২০১১)। এই এগিয়ে যাওয়া কিন্তু কোনো মানবাধিকারকর্মী বা সাংবাদিকের বদান্যতায় হয়নি, হয়েছে ‘অমানুষ’দের অমানুষিক পরিশ্রমে। আর ভারতের কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনা উন্নয়নশীল দেশের জন্য মডেল হতে পারে’ (২৬ জুলাই ২০১১, দৈনিক সকালের খবর)।
নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, সীমিত সম্পদ আর কটাক্ষকে ধারণ করে যাঁরা দিনমান সেবার চাকাটিকে চালু রেখেছেন, তাঁরা মানুষের চেয়েও কিছু বেশি। অভিধানে হয়তো নেই কিন্তু তাঁদেরকে ‘নামানুষ’ হয়তো বলা যায়। এ রকম নামানুষ ছিলেন অধ্যাপক ইব্রাহীম, অধ্যাপক এস জি এম চৌধুরী। ২০১০ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ঘোষিত ১০০ বছরের শ্রেষ্ঠ মেডিকেল গবেষণার স্বীকৃতিও যে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের কপালে আর তার জন্য যে একজন নামানুষ অধ্যাপক এম এ ফয়েজ ‘দায়ী’, সেটুকু কিন্তু সংবাদমাধ্যমের এক কোণে ছাপা হয়ে হারিয়ে গেছে। নামানুষ অধ্যাপক এম আর খান শিশুচিকিৎসায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন, তা-ও বোধকরি বিস্মৃত হয়েছি আমরা। আমরা ভুলে গেছি প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা আরেকজন ‘নামানুষ’ অধ্যাপক তাহমিনা বানু শিশু শল্যচিকিৎসায় কী অভূতপূর্ব পরিবর্তন করেছিলেন সেই বিশেষ ফিচারটি। মিজানুর রহমান-মশিউল আলম বলবেন, এই চিকিৎসকেরা ব্যতিক্রম। আমি বলব, এনারা কেবল ‘টিপ অব দ্য আইসবার্গ’। শীতল পানির তলায় আরও অসংখ্য ‘নামানুষ’ চিকিৎসক নীরবে-নিভৃতে তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন এবং তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আহমেদ হেলাল: চিকিৎসক।
soton73@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.