চারদিক-লিলুয়া বাতাসে by শারমিন নাহার

বসন্ত মানেই সূর্যের তির্যক আলো আর থেকে থেকে দমকা লিলুয়া বাতাস শরীর জুড়িয়ে দেয়। তবে এই ভালো লাগার অনুভূতিকে বাড়িয়ে দেওয়া যায়, যদি তীব্র রোদে ঝালমাখা টমেটোর স্বাদ নেওয়া যায়। তবে ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন হবে তা ভাবতেই পারিনি। বসে আছি সিলেটের অমলসিদ গ্রামের সুরমা আর কুশিয়ারার উৎপত্তিস্থল অর্থাৎ বরাক নদীর মোহনায়।

যেখানে বাঁশপাতার তিরতির কাঁপন আর পানির বহমান ধারা নজরে আসে। আর চারদিকে সুনসান নীরবতা। এই তিন নদীর মোহনার ওই পারেই প্রতিবেশী দেশ ভারত। তাই নিরাপত্তার ওপরে বিশেষ নজরদারি। কাঁটাতারের বেড়া। তবে অদূরে নিজের দেশের সীমান্তেই বিস্তীর্ণ সবজিবাগান নজরে এল। কাছে যেতেই চোখ জুড়িয়ে যায়। হরেক পদের শীতের সবজি। শীতের শেষে বসন্তে এমন বাহারি সবজির দেখা পেয়ে ভালো লাগল। তবে আরও অবাক হলাম কাঙ্ক্ষিত টমেটো দেখে। আর লোভ সামলানো গেল না। কাঁচা মাটির রাস্তা থেকে নিচে সবজির জমিতে নেমে পড়ি। উদ্দেশ্য একটাই, টমেটো তোলা। কিছু সময় বাদে খেতেই এক লোককে আবিষ্কার করি। তিনি বদরুল ইসলাম, এই জমির মালিক। তখন আর বদরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার মন নেই। মনোযোগ তখন পুরোটাই খেতের পাকা টমেটোর দিকে। অনুমতি নিয়ে খেতের টমেটো তুলতে শুরু করেছি। আর বদরুল ইসলাম তার সঙ্গে নিজেই দিলেন কাঁচা মরিচ আর ধনেপাতা, যা টমেটোর স্বাদ বাড়িয়ে দিল বহুগুণ।
পর্যাপ্ত টমেটো তুলে দাম দিতে চাইতেই বদরুল ইসলাম আপত্তি করেন। ‘যা খিতা কন, মেয়মান না আপনেরা!’ এমন আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে বদরুল ইসলামের সঙ্গে গল্প শুরু করি। পাকা টমেটোতে কামড় দিয়ে আগে চোখের তৃষ্ণা মেটাই। এর পরেই প্রশ্ন, ‘এখানে আর কী কী ফসল হয়?’ ‘যে মৌসুম তেয়ান তা অয়।’ ‘সংসার কি এই ফসল থেকেই চলে?’ এবার নিশ্চুপ বদরুল ইসলাম। রোদের কারণে মাথায় টুপি পরেই কাজ করেন। এবার কিছু সময়ের জন্য হলেও টুপিটা খোলেন। উত্তরের আগেই একটা দীর্ঘশ্বাস। উত্তর দিতে বিলম্ব। উত্তরে যা বললেন তাতে কেবলই হতাশাব্যঞ্জক শব্দের সমষ্টি। ‘এই বাগান দিয়া তো ফুরা ফরিবার চলে। সারা দিন বাগানের ফিছনে টাইম দেই উন্নত অওয়ার জন্যই। ফসলও উন্নত অয়। তয় সমস্যা হইল, এই বাগানের ফানি দেই এই নদী থেইকা। নদীর পানি বেবাগটি কইমে গেছে। মেঘবৃষ্টি না থায় খষ্ট অয়।’
বোঝাই যাচ্ছে, সুরমা আর কুশিয়ারা নদীর পানির স্তর আগের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গিয়েছে। পানি তুলে পুরোটা সবজিবাগানে দেওয়া কিছুটা সমস্যা। কিছু সময় বাদে বদরুল ইসলাম নিজে থেকেই বলেন, ‘শুনছি ঠিফাইমুখ বাঁধ অবে। ঠিফাইমুখ অয়লে নাকি আর ফানি ফাওন যাইয়তো না?’ এবার আমি নিশ্চুপ। কী বলব এই কৃষককে? আবার নিজে থেকেই তিনি বলেন, ‘ফানি না ফাইলে ফসল উন্নত হইত না। ফরিবার নিয়া খাইতাম কী?’
বদরুল ইসলাম হয়তো রিমোট কন্ট্রোল হাতে টেলিভিশনের চ্যানেল বদলে একটার পরে একটা সংবাদ দেখেন না। কিংবা পড়েন না খবরের কাগজ। তবে দেশ-বিদেশের হাজারটা খবর না রাখলেও টিপাইমুখে বাঁধ দিলে নিজেদের জীবিকার ওপরে হুমকি আসবে এমন ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েন পড়াশোনা না জানা বদরুল ইসলাম।
কী করবেন তখন বদরুল ইসলাম? ‘আল্লায় ছালাইব।’ এবার অন্য প্রশ্ন, ‘বাড়িতে আর কে কে আছে?’ ‘ফোলা থ্রিত তোইয় যায়। আর মাইয়া বেবাখ ছোড, হিতান যায় না স্কুল। ফোলাপাইনরে স্কুলে ফাঠাইতে চাই। মেলা বড় মানুষ হইবে। মাইনষে তো উন্নত অইতে চায়। আমিও চাই, যেয়াইনে বাগান হইছে। টিপাইতে বাঁধ অইলে নদীও মইরে যাবে।’
আবার একটা দীর্ঘশ্বাস। হাতে সময় নেই, সূর্য তখন মধ্যগগনে। বরাকের তীরে আমাদের কাজ শেষ। অমলসিদ ছেড়ে জকিগঞ্জের দিকে ছুটতে হবে। সবাই গাড়িতে উঠে পড়ে। তবে বারবার মনে পড়ছিল বদরুল ইসলামের আর্তি আর সারল্য মাখা মুখখানি।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.