চারদিক-পথশিশুদের আম উৎসব by রাকিব কিশোর

আম বোঝাই করে ব্যস্ত রাস্তা ধরে ছুটছে দুটি পিকআপ। একটির যাত্রীরা বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে উড়ে যাচ্ছে, আরেকটি পিকআপের অদম্য তরুণেরা রোদের তাপে ঘেমে-নেয়ে একাকার। একটি পিকআপ চলছে চট্টগ্রামের পথে, অন্যটি ঢাকার রোদজ্বলা রাস্তায়। উদ্দেশ্য একটাই—পথশিশুদের আম খাওয়ানো।

যে তরুণেরা একই পিকআপে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু একে অপরকে আগে থেকে চেনেন না। সবাই একটা ফেসবুক গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। গ্রুপটির নাম ‘আমরা খাঁটি গরিব...’।
ফেসবুক যে শুধু সময়ক্ষেপণের জায়গা না এবং এর মাধ্যমে যে আসলেই ভালো কিছু করা সম্ভব, তা এই গ্রুপটি প্রমাণ করেছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে এই গ্রুপের সদস্যরা ফেসবুকের মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ করে কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শীতার্ত মানুষের মধ্যে কম্বল দিয়ে এসেছেন, দারিদ্র্যের সেই দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত চেহারাগুলোর উল্টো পিঠে পৃথিবীর নতুন বাসিন্দাদের হাসিমুখ দেখার জন্য ওই বছরেরই ২৬ জুন পথশিশুদের মধ্যে তাঁরা আম বিতরণ করেন। ফেসবুক বন্ধুদের ছোট ছোট সাহায্য-সম্বল করে এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাঁরা আবারও উষ্ণতা নিয়ে গিয়েছিলেন লালমনিরহাটের ইটাপেতা, বুমকা ও বনগাঁও নামের তিনটি গ্রামে। অপার্থিব আনন্দ আর দুঃখী মানুষগুলোর আশীর্বাদ নিয়ে যখন তাঁরা ঢাকার পথে রওনা দেন, তখনই সিদ্ধান্ত হয়, যত কষ্টই হোক না কেন, আরও বেশি মানুষের মুখে আনন্দ দেখবেন। সে জন্যই এ বছরের ২৫ জুন ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামেও পথশিশুদের মধ্যে আম বিতরণ করেন।
অনেকেই জানতে চান, ফেসবুকের মাধ্যমে তাঁরা আম দিলেন কীভাবে? উত্তর খুবই সোজা, ‘আমরা খাঁটি গরিব...’ গ্রুপের বর্তমান সদস্যসংখ্যা চার হাজারের কাছাকাছি। পথশিশুদের আম খাওয়ানো হবে শুনে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করেন, ‘অপরাজেয় বাংলা’ নামের একটি সংগঠন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় শ্রমজীবী বা পথশিশুদের জন্য স্কুল পরিচালনা করে, যাকে বলে স্ট্রিট স্কুল। সেই স্কুলের ৪৭০ জন শিশুকে দেওয়া হবে আম। আর চট্টগ্রামে পথশিশুদের স্কুল পরিচালনা করে ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন’ নামের একটি সংগঠন; তাদের প্রায় ৬০০ শিশুকে আম খাওয়ানো হবে। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকেই গ্রুপের সদস্যরা কেউ নিজে রিকশা ভাড়া, কেউ এক দিনের মোবাইল ফোনের বিলের টাকা, আবার কেউ বা তাঁর বিকেলের ডালপুরি খাওয়ার টাকাও জমা দেন গ্রুপের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। তাঁদের সাহায্যে এ বছর এগিয়ে আসে ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন রেডিও ‘রেডিও আহা!’ এক মাসজুড়ে প্রতি ঘণ্টায় তাঁরা পথশিশুদের আম উৎসবে সাহায্য করার জন্য মেসেজ প্রচার করতেন সবার জন্য। সেই মেসেজ পেয়ে দেশের বাইরে থেকেও উচ্চবিত্তরা পথশিশুদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। সবার কাছ থেকে পাওয়া সেই টাকা দিয়ে এবারে কেনা হয় ৬৪৫ কেজি আম। ভাড়া করা হয় পিকআপ। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে চট্টগ্রামের পিকআপটি ছুটে যায় ওয়ার্ল্ড ভিশন স্কুলের ১৫টি শাখার প্রায় ৬০০ পথশিশুর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। আর ঢাকার পিকআপটি মাঝবয়সী দিনে সেদ্ধ হওয়া গরমের মধ্যে আম বিলিয়ে বেড়ায় গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে শুরু করে মিরপুর মাজার রোড, মোহাম্মদপুর, কমলাপুর, হাইকোর্ট, নিউমার্কেট, চন্দ্রিমা উদ্যান, রায়েরবাজার ও ধানমন্ডি লেকের পাড়ে জামাকাপড়বিহীন ধুলাবালু মাখানো রোগে-শোকে ভোগা বাচ্চাদের মধ্যে। একেকটি স্কুলে পিকআপ থামে আর শুরু হয় স্কুলের শিক্ষার্থীদের উল্লাস। কমলাপুরের ফোকলা দাঁতের আনিস তাকে দেওয়া দুটি আম পকেটে পুরে আবার দুই হাত বাড়িয়ে দেয়। আগের আম দুটি কোথায়—জানতে চাইলে সরলভাবে হেসে সে উত্তর দেয়, ‘ওই আম দুইটা তো পকেট খাইয়া ফালাইছে, আরও দুইটা দেন, আমি খামু।’ মা-বাবাহারা আনিসের ওই বাড়িয়ে দেওয়া কচি হাতগুলো বেশিক্ষণ খালি থাকতে দেননি তাঁরা। চন্দ্রিমা উদ্যানে অবস্থিত স্কুলের শিশুদের মধ্যে এবারও সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল গত আম উৎসবের নায়ক সাব্বির। বয়স এক বছর বাড়ার কারণেই কি না, সে এবার একটু লাজুক ছিল। মিরপুরের মাজার রোডে অবস্থিত স্কুলের মেয়েদের নাচ-গান-কবিতা মনে হয় অনেক দিন কেউ ভুলতে পারবে না।
প্রতিবন্ধী এক শিশুকে তার মা বোধ হয় কিছুক্ষণ আগেই মেরেছিলেন, ছলছল চোখ নিয়ে সে দুটি আম হাতে নেয়। পাকা আমের হলুদ রঙে মুহূর্তেই তার চোখের রং বদলে যায়, ছেঁড়া জামার আস্তিন দিয়ে চোখটা মুছেই কামড় দিয়ে বসে সদ্য ধুয়ে দেওয়া আমটায়। মুখভর্তি আম নিয়ে যখন সে ‘আমরা খাঁটি গরিব...’ বন্ধুদের দিকে তাকায়, তখন তার দুচোখে খুশির ঝিলিক, অদূরে তার মায়ের চোখে খুশির কান্না। হাসি-কান্না দুটিই একসঙ্গে, কী সুন্দর দৃশ্য!
‘আমরা খাঁটি গরিব...’ গ্রুপের তরুণদের আনন্দ দেখে চট্টগ্রামের এক মাছ ব্যবসায়ী হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। গ্রুপের একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই আম বিলানোর উদ্দেশ্য কী?’ উদ্দেশ্য একটাই—হাসিমুখ দেখা। মাত্র দুটি আম পেয়ে ধুলাবালুকে বন্ধু বানিয়ে ফেলা শিশুগুলোর মুখে যে হাসি ফুটেছে, তা কজন দেখতে পারে? প্রতিটি স্কুল থেকেই যখন গ্রুপের সদস্যরা বের হয়ে আসতেন, তখন শিশুরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলত, ‘আফনেরা আবার আইসেন কিন্তু।’
গ্রুপের সদস্যদের কাউকেই কিছু বলে দিতে হয়নি, কিন্তু সবার মনে একই প্রতিজ্ঞা, ‘আমরা আবার আসব। তোমাদের ওই ফোকলা দাঁতের হাসিটা দেখার জন্য আমরা আবার আসব।’
রাকিব কিশোর

No comments

Powered by Blogger.