হাওরের বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে by আখলাক হুসেইন খান

কৃষিনির্ভর অঞ্চলের জলাধারার গুরুত্বপূর্ণ নদীর উজানে বাঁধ বা ব্যারেজ হলে কি পরিণতি হয় ফারাক্কা ব্যারেজের ভাটিতে পদ্মাই তার প্রমাণ। যার খেসারত দিতে গিয়ে প্রমত্তা পদ্মার চওড়া এক হাজার ৮০০ মিটার থেকে বিভিন্ন স্থানে ৪০০ মিটারে নেমে যাওয়াসহ মরা খালে পরিণত হয়েছে।

পানির স্তর ৩০ থেকে ৪০ ফুট নিচে নেমে উত্তরাঞ্চলের ছয় জেলায় মরু প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শাখা-প্রশাখার ৩০টি নদী মরে যাওয়াসহ ৮০টি নদী একেবারেই বিপন্ন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও ১৮টি অভিন্ন নদীর উজানে ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণে পানি প্রত্যাহার করার ফলে ৮৩টিরও অধিক নদীর অধিকাংশই এখন মৃত ও মুমূর্ষ। বর্ষায় হাওরের পানির জোগান অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ ২২ হাজার ২২ কিলোমিটার পানির বিস্তার থেকে পাঁচ-ছয় বর্গকিলোমিটারে ঠেকেছে। হাওরে পরিবেশ-প্রতিবেশ, জলজ উদ্ভিদ, কৃষি, প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন। যা রক্ষার জন্য পরিবেশকর্মী ও হাওরবাসী দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এ পরিস্থিতিতে টিপাইমুখে ড্যাম হলে কি প্রভাব ফেলবে বিপন্ন হাওরাঞ্চলের হাল অবস্থার নিরিখে বৈজ্ঞানিক আলোচনা ও সমীক্ষার হিসাব তোলে ধরা উচিত। শুধু শুধু বিভ্রান্ত সৃষ্টি করে সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হবে আত্মঘাতী। যা বেশ কিছু দিন যাবৎ প্রথম আলো পত্রিকায় বিভিন্ন নিবন্ধনের মাধ্যম হয়ে আসছে। ফ্যাপ-৬ সমীক্ষা আইডাবি্লউএমের মডেল স্টাডির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর হিসাব-নিকাশ যে অনেকটাই ধারণাপ্রসূত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাই বলে আসছেন। এ ড্যাম সম্পর্কে ভারত আজ পর্যন্ত কোনো তথ্য-উপাত্তই সরবরাহ করেনি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর চিত্র ও পানি প্রবাহের গতি-প্রকৃতির হিসাব না কষেই ১৫ থেকে ২০ বছর আগের সমীক্ষার হিসাব গ্রহণযোগ্য নয় বলেই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যৌথ সমীক্ষার দাবি উঠেছে। সরকারও তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ ও যৌথ সমীক্ষার জন্য ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মোদ্দাকথায় ড্যামের তথ্য-উপাত্ত যেমন দরকার তেমনি ভাটির নদ-নদী ও জলাভূমির হাল অবস্থারও তথ্য দরকার। এ দুয়ের সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ সমীক্ষা চালালে নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠবে।
হাওরের আদি বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এলেও এখনো ঠেকিয়ে রেখেছে অভিন্ন সুরমা-কুশিয়ারা নদী ও এর পানি প্রবাহ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে খরা-বন্যার প্রকোপ বেড়েছে সমান তালে। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও স্বল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতে সাংবাৎসরিক বন্যার পানিতে পাহাড় ধোয়া পলি-বালি ও নদীর পাড় ভাঙা মাটি-আবর্জনা তলদেশে সঞ্চারিত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী ভাটিতে শীর্ণকায় ও মুমূর্ষ। তার পরও ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে বয়ে আসা ২০টি উপনদীর পানি প্রাপ্তিতে সুরমা ও কুশিয়ারা সারা দেশে ৯ শতাংশ পানি দেয়। গামলার আকৃতি নিম্নভূমি হাওরাঞ্চলে বর্ষায় কি পরিমাণ পানি আসে তার সঠিক কোনো তথ্য মিলেনি। অনেকের ধারণাপ্রসূত তথ্যে জ্যৈষ্ঠ এবং কার্তিক মাস পর্যন্ত ছয় মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার মিলিয়ন কিউসেক পানির জোগান বহাল আছে। ওই পানি মেঘনা নদী ধরে লিন হতে ছয় মাস লাগে, তাই হাওরগুলো ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে এবং এ সময় শাখা-প্রশাখা নদী ও নদীর খাড়ি এবং খাল-নালা ও জলাশয়গুলোতে প্রচুর পানি ধরে রাখে- যা পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখাসহ কৃষিতে সেচের জোগান হয়ে থাকে। পানির সঙ্গে জলাশায়গুলোতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছ আটকে থাকে। এ পানির মূল উৎস এখন বরাক নদ ও এর অববাহিকা। ত্যু-ভাই (টিপাই), ত্যু-বয়ং, সাঙ্গু, লঙ্গাই, সোনাই ও ধলেশ্বরী উপনদীর স্রোতধারায় ২৭৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বরাক একটি নদী প্রণালি। যার স্রোতধারা সুরমা ও কুশিয়ারা নদী।
১৯৯২-৯৫ সালের ফ্যাপ-৬ এর তথ্য মতে, সুরমা ও কুশিয়ারায় উপনদীর মাধ্যমে পানি আসে ৩১ শতাংশ মেঘালয় থেকে, পাঁচ শতাংশ ত্রিপুরা থেকে এবং ১৬ শতাংশ আসে মনিপুর, মিজোরাম ও আসামের বিস্তৃত বরাক অববাহিকা থেকে।
এ তথ্য উপস্থাপন করে পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বরাক অববাহিকা তেমন গুরুত্ব বহন করে না বলে দেখাতে চেয়েছেন, এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ২৯ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে প্রথম আলোতে লেখা তাঁর একটি নিবন্ধে। তাঁর হয়তো জানা নেই বা এড়িয়ে গেছেন ১৯৯৬-৯৭ সালেই ভারত গুরুত্বপূর্ণ মনু, ধলাই, খোয়াই, সোনাই নদীতে অবকাঠামো গড়ার কাজ সম্পন্ন করেছে এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ বছরের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে সম্পন্ন করছে সারি-গোয়াইন নদীর উৎস মাইনথ্রো নদীর ড্যাম। ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ২২টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ১৮টি নদীর উজানে পানি প্রবাহের হিসাব পাল্টে এখন প্রকৃতি ও বৃষ্টিপাত-নির্ভর হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে গত একযুগ ধরে বর্ষাকালীন অনাবৃষ্টি ও খরার প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। বৃষ্টিপাত কম হলে উজান থেকে ওই সব উপনদী থেকে পানি আসে নামে মাত্র। অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাত ও বরাক প্রণালি ধরে যে পানি নামে তা দিয়ে সীমিত এলাকায় বর্ষার রূপ নিতে দেড় থেকে দুই মাস পিছিয়ে যায়। পানির বিস্তারও কমে যায়। আর অতিবৃষ্টি হলেই ভারত অবকাঠামোর সব কয়টি ফ্লাড গেইট খুলে দেয়। তখন নাব্য হারা নদীতে একসঙ্গে পানি নেমে পাড় ছাপিয়ে হাওরে প্রবেশ করে (চৈত্র মাসেই) আগাম বন্যার সৃষ্টি করে সাতটি জেলার ভাটি বা নিচু হাওরে আবাদকৃত একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে বরাকের টিপাইমুখে ড্যাম হলে সমীক্ষা ও স্টাডিতে বর্ষায় ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পানি প্রবাহ কমে যাবে বলে বলা হয়েছে। অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ৫ জানুয়ারি প্রতিক্রিয়া নিবন্ধের বক্তব্যে ছিল সাধারণ কমনসেন্স দিয়েই ৯০ শতাংশ বুঝে ফেলা যায়। প্রশ্নবিদ্ধ এই তথ্য ছাড়াই সাধারণ কমনসেন্সে বোঝা যায়, বৃষ্টি মৌসুমে অর্থাৎ বর্ষায় এই দৈত্যাকৃতি জলাধার পূর্ণ করার কারণে ভাটিতে বরাক অববাহিকার পানি ছাড়বে না। প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক ১৪ জানুয়ারি তাঁর প্রতিক্রিয়া নিবন্ধে হিসাব দিয়েছেন, বরাক নদ বন্ধ করে দেওয়া হলে বছরে মোট পানি জমবে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ঘনমিটার। এভাবে জলাধারে ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি জমতে চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে। জলাধার পূর্ণ না করে আংশিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে জলাধার পূর্ণ করতে ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যাবে। তা হলে সাধারণ কমনসেন্স দিয়েই বোঝা যায়, ১৯টি উপনদীর পানি প্রত্যাহারের পর একমাত্র ভরসা বরাক অববাহিকার পানি প্রত্যাহার হলে হাওরে বর্ষার বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য বলতে কিছু থাকবে না। সীমান্তের ওপারে পাহাড়ি ঢল হলেই বন্যা দেখা দেবে এবং সব ফ্লাড গেইটে একসঙ্গে পানি ছাড়ায় পলি-বালি এসে নদীর তলদেশ ও জলাশয়গুলোতে সঞ্চারিত হওয়ার প্রবণতা বহুগুণে বেড়ে যাবে। এ ছাড়া বৃষ্টিপাত কম হলে সুরমা ও কুশিয়ারার পানি প্রবাহ কমে ভাটির মুমূর্ষ অংশে পলি-বালি জমে দ্রুত মরে যাবে। প্রতিবন্ধকতায় নদীর অস্বাভাবিক গতি-প্রকৃতির কারণে ১৫২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য মেঘনা নদী প্রণালির অবস্থাও এমনটি যে হবে বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনিতেই মেঘনায় অনেক ডুবোচর গজিয়ে উঠেছে। ভৈরবের উজানে সুরমা, কুশিয়ারা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের মিলন মোহনার ভাটিতে মেঘনার ভৈরব পয়েন্টে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বর্ষায় এখনো ১৯ হাজার ৪শ' ৮৫ ঘনমিটার পানি প্রতি সেকেন্ডে প্রবাহিত হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি অঙ্গরাজ্য (সপ্ত কন্যা) ও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ধান-মাছের ভাণ্ডার প্লাবন ভূমির সাতটি জেলায় বছরে চার থেকে পাঁচ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাতই এ অহিমালয়ী নদীগুলোরও হাওরের জলরাশির উৎস। এই উৎস মুখে যেকোনো ধরনের অবকাঠামো হলে নদীর গতি-প্রকৃতি পাল্টে হাওরের বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য হারাবেই। যেমনটি হয়েছে পদ্মাপাড়ের বেলায়।
লেখক : হাওর গবেষক

No comments

Powered by Blogger.