দুই দু’গুণে পাঁচ-যানজটের পরিণতি! by আতাউর রহমান

একদা বিলেতের ব্যস্ততম রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার দৌরাত্ম্যে হেঁটে রাস্তা পারাপারকালে জনৈক বিদ্বজ্জন ব্যক্তি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘দ্য সেইফেস্ট ওয়ে টু গো টু দ্য আদার সাইড অব দ্য রোড ইজ টু বি বর্ন দেয়ার; অর্থাৎ রাস্তার অপর পারে যাওয়ার সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা হচ্ছে ওখানেই জন্ম নেওয়া।’ অধুনা ঢাকার ব্যস্ততম রাস্তাগুলো হেঁটে পারাপারকালে কথাটা প্রায়ই আমার মনে পড়ে যায় এবং বন্ধুবান্ধবদের উদ্দেশে বলেও থাকি।

সত্যি বলতে কি, আজকাল সকাল-সন্ধ্যায় ঢাকার রাস্তায় পারাপারের উদ্দেশ্যে দাঁড়ালে মনে হয় যেন অনেক অনেক লোক অনেক অনেক গাড়িতে চড়ে অনেক অনেক তাড়াহুড়া করে অনেক অনেক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছেন—এটার কোনো বিরাম নেই, এঁদের কোনো ক্লান্তিও নেই। আর গাড়িগুলোর গতিবেগ হচ্ছে কেবল দুটো—লফুল (Lawful) ও অফুল (awful); অর্থাৎ আইনানুগ ও বেআইনি তথা বিপজ্জনক। যাঁরা অফুল গতিতে গাড়ি চালান, তাঁদের উচিত হবে নিম্নোক্ত বহুল কথিত বিদেশি গল্পটা সব সময় স্মরণ রাখা—
জনৈক যুবক নতুন মোটরগাড়ি কিনে স্থানীয় ধর্মযাজকের কাছে গিয়ে বলল, ‘ফাদার, দোয়া করুন আমি গাড়িটা চালাতে গিয়ে যেন অ্যাক্সিডেন্ট না করি।’ তদুত্তরে ফাদার হাত তুলে বললেন, ‘দোয়া করলাম। কিন্তু স্মরণ রেখো, দোয়াটা ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ৫০ মাইল পর্যন্ত ভ্যালিড (valid)।’
তবে এটাও সত্যি যে, এখনকার দিনে যানবাহন অত্যাবশ্যক। খ্রিষ্টধর্মের সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম প্রচারক সেইন্ট পল (Paul) যাঁর পূর্বতন ইহুদি নাম ছিল সল (Saul) ও যিনি নব্য খ্রিষ্টানদের নির্যাতন করে বেড়াতেন এবং একদিন অকস্মাৎ দৈব আওয়াজ শুনে নির্যাতনকারী থেকে মিশনারিতে পরিণত হলেন, হেঁটে হেঁটে গোটা এশিয়া মাইনরে ধর্মপ্রচার করে বেড়িয়েছেন। বর্তমানের ধার্মিক খ্রিষ্টানদের অনেকে নাকি ভেবে ভেবে হয়রান, কী করে তিনি গাড়ি-ঘোড়া ব্যতিরেকে এতটা জনপদ নগ্নপদে চষে বেড়ালেন। তাই তো, এখনকার সব ধর্মের যাজকেরাই যে যানবাহন ছাড়া এক পাও এগোতে চান না!
সে যা হোক। একসময় আমাদের ঢাকায় ঘোড়ার গাড়িই ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। লবণ ও চামড়ার ব্যবসায়ে প্রভূত অর্থবিত্ত লাভ করে ঢাকার নবাব বংশের প্রতিষ্ঠাতা খাজা আলীমুদ্দিন যখন বিশাল ভূ-সম্পত্তির অধিকারী হলেন, তখন সামাজিক প্রতিপত্তি লাভের আশায় তিনি কতিপয় উন্নত জাতের ঘোড়া আমদানি করেছিলেন। আর ঢাকার ভাড়ায় খাটানো ঘোড়ার গাড়ি টমটমের নাম ধার করে ইদানীংকালে ব্রিটিশরা মোটরগাড়িতে ব্যবহার্য একটি ছোট্ট ইলেকট্রনিক যন্ত্র আবিষ্কার করে নাম দিয়েছে ‘টমটম’, যেটার সাহায্যে যে কেউ অনায়াসেই পথ না-জানা গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারবেন। এমনকি গন্তব্যে পৌঁছানোর পর ওটা সশব্দে তাকে বলে দেবে, ‘আপনি গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন’; আর সেখানে গাড়ি না থামালে আবার গায়েবি আওয়াজ হবে, ‘এই মাত্র আপনি আপনার গন্তব্য অতিক্রম করে গেলেন।’ বিধাতা মানুষকে কী অদ্ভুত উদ্ভাবনী শক্তিই না দিয়েছেন!
তা বর্তমানে ঢাকায় তথা আমাদের দেশে ঘোড়ার গাড়ির পরিবর্তে মোটরগাড়িই হচ্ছে প্রধানত আভিজাত্যের প্রতীক; এবং এটা যানজটের আদি অকৃত্রিম কারণও বটে। তবে হ্যাঁ, দামি গাড়ি হাঁকানোর অর্থ সব সময় এই নয় যে, আপনি অভিজাত বংশের কিংবা অগাধ টাকার মালিক। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে যে, তিনি ব্যাংকের একজন বড় ঋণখেলাপি। আর আপনি দামি গাড়ি হাঁকান ঠিকই, তবে আপনাকেও হাঁকান ততোধিক দামি আপনার সহধর্মিণী। এ জন্যই বুঝি পাশ্চাত্যের এক লোককে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনার সহধর্মিণী কি এখনো গাড়ি চালানো শেখেননি’, তখন তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘হ্যাঁ, তবে অ্যাডভাইজরি ক্যাপাসিটিতে।’ অর্থাৎ তিনি যখন গাড়ি চালান, তখন তাঁর সহধর্মিণী পাশে বসে উপদেশবারি বর্ষণ করতে থাকেন, ‘ট্রাফিক সিগন্যালের প্রতি লক্ষ করো’, ‘ডাইনে চালাও’, ‘বাঁয়ে যাও’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাশ্চাত্যে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব গাড়িওয়ালাই নিজেরা ড্রাইভিং করেন; বেতনভুক ড্রাইভার রাখা তাঁদের জন্য বিলাসিতা, এমনকি সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও অফিসের গাড়ি নিজেরাই ড্রাইভ করে থাকেন। আমাদের দেশে কারণে-অকারণে ড্রাইভার রাখা এক রকম রেওয়াজেই পরিণত হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন ড্রাইভারদের বেতন শনৈঃশনৈঃ বাড়ছে, অপরদিকে তেমন ভালো ড্রাইভার পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তো এক ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলছিলেন, ‘আমাদের নতুন ড্রাইভারটা একেবারে অপদার্থ, ওকে বরখাস্ত করতেই হয়। আমাকে সে চার-চারবার মেরে ফেলেছিল প্রায়।’
‘আহ্, ওকে আরেকটা সুযোগ দাও’, স্ত্রী গম্ভীর কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন।
অবশ্য আমাদের দেশে মহিলাদের মোটরগাড়ি ড্রাইভ করতে খুব একটা দেখা যায় না। ইরানে দেখেছি, শত শত মহিলা বোরকা পরে গাড়ি হাঁকাছেন; আর সৌদি আরবে মহিলাদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ বিধায় ইদানীং কিছু মহিলা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন আর আমেরিকার সাবেক ফার্স্ট লেডি ও বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাঁদের সঙ্গে একাত্মতাও ঘোষণা করেছেন।
তো মেয়েদের ড্রাইভিং নিয়ে বিদেশে অনেক মজার মজার গল্প প্রচলিত আছে। এই যেমন মহিলা মাত্রাতিরিক্ত বেগে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন দেখে পুলিশ পিছু নিয়ে অনেক কষ্টে তাঁকে থামালেন। কিন্তু পুলিশ এগিয়ে আসতেই তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমাকে থামাবেন না। আমার গাড়ির ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না; তাই আমি তাড়াহুড়া করে চালাচ্ছি, যাতে করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই বাড়ি পৌঁছে যাই।’ তা গল্প গল্পই।
বিখ্যাত ব্রিটিশ পরিব্রাজক স্যার ওয়াল্টার রেলের এক সুযোগ্য উত্তরসূরি নাকি একবার আমেরিকায় বর্ষা-প্লাবিত রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে এক মহিলাকে তাঁর গাড়ির ভেতর দিয়ে গিয়ে শুকনো পায়ে নিজের গাড়িতে উঠতে সাহায্য করে ও উপরন্তু মাথার হ্যাট তুলে সম্মান দেখিয়ে পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন।
আমিও অনেকটা অনুরূপ ঘটনায় সম্প্রতি অভিষিক্ত হয়েছিলাম: যাচ্ছিলাম পাড়ার মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে। রাস্তাটা এক জায়গায় কাটা, যেটা কাটা হয়েছিল বছর খানেক আগে গ্যাস লাইন মেরামত উপলক্ষে। গ্যাস কোম্পানি সিটি করপোরেশনকে তৎপূর্বে যথারীতি মোটা টাকা পেমেন্ট করলেও সিটি করপোরেশনের যেটা স্বভাব, বিগত এক বছরে কিছু ইটের খোয়া বিছানো ছাড়া কিছুই করা হয়নি, আর হবেও না। ফলে বৃষ্টি হলেই ওখানে পানি জমে যায়। সেদিনও ওখানে পানি ছিল এবং আমি ওই জায়গাটা অতিক্রমকালে হঠাৎ একটি চলমান গাড়ি দৃশ্যতই আমাকে ময়লা পানির ঝাপটা থেকে বাঁচানোর জন্য থেমে গেল; অতঃপর মোট আরোহী দুই যুবক, আমার দিকে তাকানোয় আমি সহাস্যে ওদেরকে আগে চলে যেতে ইশারা করলাম। ওরা আমার হাসিটা ফেরত দিয়ে মস্তক খানিকটা অবনত করে আমাকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক চলে গেল। ব্যাপারটা আমার মনে তখন খুব দাগ কেটেছিল। তৎক্ষণাৎ এই লেখাটার চিন্তা আমার মাথায় এসে গিয়েছে। ভেবেছিলাম, ঘটনাটা আনুপূর্বিক বর্ণনা করে পরিশেষে লিখব যে, অনেকে যে বলেন, একটা প্রজন্ম প্রায় পচে গেছে, তা বোধকরি যথার্থ নয়।
কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই সংঘটিত অপর একটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ঘটনা আমার সমগ্র চিন্তাভাবনাকে তছনছ করে দিয়ে গেল। নিত্যকার অভ্যেসমতো সস্ত্রীক ধানমন্ডি লেকপাড়ে হাঁটাহাঁটি শেষে প্রত্যাবর্তনকালে বাসার একেবারে সামনেই সকাল সোয়া ছয়টায় দুই যুবক গাড়ি থামিয়ে চাকু ও রড দেখিয়ে স্ত্রীর হাতের স্বর্ণালংকার ও আমার পকেটের টাকাগুলো হাতিয়ে মুহূর্তের মধ্যে খালি রাস্তায় গাড়িতে উধাও; যাওয়ার কালে আমার হাতের ছাতাটাও নিতে ভুলল না। ওরা ছিল দুজন, এরাও দুজন; অথচ কী বিপরীতধর্মী আচরণ!
জীবনে বিবিধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই আমাদের উত্তরণ হয়। ছিনতাইয়ের এই অভিজ্ঞতা আমার বাকি ছিল। আর যানজটের উপকারিতা হচ্ছে, যানজটকালে রাস্তা পারাপার হওয়া সহজতর। এক্ষণে দেখা যাচ্ছে, যানজটটা ভোর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলে গাড়ি নিয়ে সহজে পালানো যাবে না বিধায় এ ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটবে না। অতএব জয় হোক যানজটের! শনৈঃশনৈঃ প্রবৃদ্ধি হোক যানবাহনের!!
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.